এবার মোহিনী বুঝিতে পারিয়া শিহরিয়া উঠিল। ব্যস্ত হইয়া তাহার মুখে হাত চাপা দিয়া বলিয়া উঠিল, ছি ছি, ও কথা মুখে এনো না দিদি! আত্মহত্যার কথা যে বলে তার পাপ, যে কানে শোনে তার পাপ, ছি ছি, কি হয়ে গেলে তুমি!
বিরাজ হাত সরাইয়া দিয়া বলিল, তা জানিনে। শুধু জানি, ওঁকে আর খেতে দিতে পারচি নে। আজ আমাকে ছুঁয়ে কথা দে তুই, যেমন ক’রে পারিস দুই ভায়ে মিল করে দিবি।
কথা দিলুম, বলিয়া মোহিনী সহসা বসিয়া পড়িয়া বিরাজের পা চাপিয়া ধরিয়া বলিল, তবে আমাকেও আজ একটা ভিক্ষে দেবে বল?
বিরাজ জিজ্ঞাসা করিল, কি?
তবে এক মিনিট সবুর কর আমি আসছি, বলিয়া সে পা বাড়াতেই বিরাজ আঁচল ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, না যাসনে। আমি একটি তিল পর্যন্ত কারু কাছে নেব না।
কেন নেবে না?
বিরাজ প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া বলিল, না, সে কোনমতেই হবে না, আর আমি কারও কিছু নিতে পারব না।
ছোটবৌ ক্ষণেকের জন্যে স্থিরদৃষ্টিতে বড়জার আকস্মিক উত্তেজনা লক্ষ্য করিল। তারপর সেইখানে বসিয়া পড়িয়া তাহাকে জোর করিয়া টানিয়া কাছে বসাইয়া বলিল, তবে শোন দিদি। কেন জানিনে, আগে তুমি আমাকে ভালবাসতে না, ভাল ক’রে কথা কইতে না, সেজন্য কত যে নুকিয়ে বসে কেঁদেচি, কত দেবদেবীকে ডেকেচি, তার সংখ্যাই নাই। আজ তাঁরাও মুখ তুলে চেয়েছেন, তুমিও ছোটবোন বলে ডেকেচি। এখন একবার ভেবে দেখ, আমাকে এই অবস্থায় দেখে কিছু না করতে পেলে তুমি কিরকম ক’রে বেড়াতে?
বিরাজ জবাব দিতে পারিল না। মুখ নীচু করিয়া রহিল।
ছোটবৌ উঠিয়া গিয়া অনতিকাল পরে একটা বড় ধামায় সর্বপ্রকার আহার্য পূর্ণ করিয়া আনিয়া নামাইয়া রাখিল।
বিরাজ স্থির হইয়া দেখিতেছিল, কিন্তু সে যখন কাছে আসিয়া তাহার আঁচলের একটা খুঁট তুলিয়া একখানা মোহর বাঁধিতে লাগিল, তখন সে আর থাকিতে না পারিয়া সজোরে ঠেলিয়া দিয়া চেঁচাইয়া উঠিল, না, ও কিছুতেই হবে না—ম’রে গেলেও না।
মোহিনী ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া মুখ তুলিয়া বলিল, হবে না কেন, নিশ্চয় হবে। এ আমার বঠ্ঠাকুর আমাকে বিয়ের সময়ে দিয়েছিলেন। বলিয়া আঁচলে বাঁধিয়া দিয়া আর একবার হেঁট হইয়া পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া বাড়ি চলিয়া গেল।
বিরাজবৌ – ১১
এগার
মগরার এতদিনের পিতলের কবজার কারখানা যেদিন সহসা বন্ধ হইয়া গেল এবং এই খবরটা চাঁড়ালদের সেই মেয়েটি বিরাজকে দিতে আসিয়া ছাচ বিক্রির অভাবে নিজের নানাবিধ ক্ষতি ও অসুবিধার বিবরণ অনর্গল বকিতে লাগিল, বিরাজ তখন চুপ করিয়া শুনিল। তারপর একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিল মাত্র। মেয়েটি মনে করিল, তাহার দুঃখের অংশী মিলিল না, তাই ক্ষুন্ন হইয়া ফিরিয়া গেল। হায় রে, অবোধ দুঃখীর মেয়ে, তুই কি করিয়া বুঝিবি সেইটুকু নিশ্বাসে কি ছিল, সে নীরবতার আড়ালে কি ঝড় বহিতে লাগিল! শান্ত নির্বাক ধরিত্রীর অন্তস্তলে কি আগুন জ্বলে, সে বুঝিবার ক্ষমতা তুই কোথায় পাইবি!
নীলাম্বর আসিয়া বলিল, সে কাজ পাইয়াছে। আগামী পূজার সময় হইতে কলিকাতার এক নামজাদা কীর্তনের দলে সে খোল বাজাইবে।
খবর শুনিয়া বিরাজের মুখ মৃতের মত পান্ডুর হইয়া গেল। তাহার স্বামী গণিকার অধীনে, গণিকার সংস্রবে সমস্ত ভদ্র-সমাজের সম্মুখে গাহিয়া বাজাইয়া ফিরিবে! তবে, আহার জুটিবে! লজ্জায় ধিক্কারে সে মাটির সহিত মিশিয়া যাইতে লাগিল, মুখ ফুটিয়া নিষেধ করিতেও পারিল না—আর যে কোন উপায় নাই। সন্ধ্যার অন্ধকারে নীলাম্বর সে মুখের ছবি দেখিতে পাইল না—ভালই হইল।
ভাঁটার টানে জল যেমন প্রতিমুহূর্তে ক্ষয়চিহ্ন তটপ্রান্তে আঁকিতে আঁকিতে দূর হইতে সুদূরে সরিয়া যায়, ঠিক তেমনই করিয়া বিরাজ শুকাইতে লাগিল। অতি দ্রুত অতি সুস্পষ্টভাবে ঠিক তেমনই করিয়া তাহার দেহতটের সমস্ত মলিনতা নিরন্তর অনাবৃত করিয়া দিয়া তাহার দেববাঞ্ছিত অতুল যৌবনশ্রী কোথায় অন্তর্হিত হইয়া যাইতে লাগিল। দেহ শুষ্ক, মুখ ম্লান, দৃষ্টি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল—যেন কি একটা ভয়ের বস্তু সে অহরহ দেখিতেছে। অথচ তাহাকে দেখিবার কেহ নাই। ছিল শুধু ছোটবৌ; সেও মাসাধিক কাল ভাইয়ের অসুখে বাপের বাড়ি গিয়াছে। নীলাম্বর দিনের বেলা প্রায়ই ঘরে থাকে না। যখন আসে তখন রাত্রির আঁধার, তাহার দুই চোখ প্রায়ই রাঙ্গা, নিশ্বাস উষ্ণ বহে। বিরাজ সবই দেখিতে পায়, সবই বুঝিতে পারে, কিন্তু কোনো কথাই বলে না। বলিতে ইচ্ছাও করে না, তাহার সামান্য কথাবার্তা কহিতেও এমনি ক্লান্তি বোধ হয়।
কয়েকদিন হইল, বিকাল হইতে তাহার শীত করিয়া মাথা ধরিয়া উঠিতেছিল, এই লইয়াই তাহাকে স্তিমিত সন্ধ্যা-দীপটি হাতে করিয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করিতে হইত। স্বামী বাড়ি থাকেন না বলিয়া, দিনের বেলা আর সে প্রায়ই রাঁধিত না, রাতে ভাত রাঁধিত, কিন্তু তখন তাহার জ্বর। স্বামীর খাওয়া হইয়া গেলে হাত-পা ধুইয়া শুইয়া পড়িত। এমনই করিয়া তাহার দিন কাটিতেছিল। ঠাকুর-দেবতাকে বিরাজ আর মুখ তুলিয়া চাহিতেও বলে না, পূর্বের মত প্রার্থনাও জানায় না। আহ্নিক শেষ করিয়া গলায় আঁচল দিয়া যখন প্রণাম করে, তখন শুধু মনে মনে বলে, ঠাকুর যে পথে যাচ্ছি, সে পথে যেন একটু শিগগির ক’রে যেতে পাই।
সেদিন শ্রাবণের সংক্রান্তি। সকাল হইতে ঘন-বৃষ্টিপাতের আর বিরাম ছিল না। তিন দিন জ্বর-ভোগের পর বিরাজ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আকুল হইয়া সন্ধ্যার পর বিছানায় উঠিয়া বসিল। নীলাম্বর বাড়ি ছিল না। পরশু, স্ত্রীর এত জ্বর দেখিয়াও তাহাকে শ্রীরামপুরের এক ধনাঢ্য শিষ্যের বাটীতে কিছু প্রাপ্তির আশায় যাইতে হইয়াছে, কিন্তু কথা ছিল কোনোমতেই রাত্রিবাস করিবে না, যেমন করিয়া হউক সেইদিনই সন্ধ্যা নাগাদ ফিরিয়া আসিবে।
পরশু গিয়াছে, কাল গিয়াছে, আজও যাইতে বসিয়াছে, তাহার দেখা নাই। অনেকদিনের পর আজ সমস্ত দিন ধরিয়া বিরাজ যখন-তখন কাঁদিয়াছে। অনেকদিনের পর আজ সে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর পায় মানত করিতে করিতে তাহার সমস্তই নিঃশেষ করিয়াছে। আর কিছুতেই শুইয়া থাকিতে না পারিয়া, সন্ধ্যা জ্বালিয়া দিয়া একটা গামছা মাথায় ফেলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বাহির পথের ধারে আসিয়া দাঁড়াইল। বর্ষার অন্ধকারের মধ্যে যতদূর পারিল চাহিয়া দেখিল, কিন্তু, কোথাও কিছু দেখিতে না পাইয়া ফিরিয়া আসিয়া ভিজা কাপড়ে, ভিজা চুলে, চণ্ডীমণ্ডপের পৈঠায় হেলান দিয়া বসিয়া এতক্ষণ পরে ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল। কি জানি, তাঁহার কি ঘটিল! একে দুঃখে কষ্টে অনাহারে দেহ তাঁহার দুর্বল, তাহাতে পথশ্রম—কোথায় অসুখ হইয়া পড়িলেন, না গাড়ি-ঘোড়া চাপা পড়িলেন, কি হইল, কি সর্বনাশ ঘটিল—ঘরে বসিয়া সে কি করিয়া বলিবে, কেমন করিয়া কি উপায় করিবে! আর একটা বিপদ, বাড়িতে পীতাম্বরও নাই, কাল বৈকালে সে ছোটবধূকে আনিতে গিয়াছে, সমস্ত বাড়ির মধ্যে বিরাজ একেবারে একা। আবার সে নিজেও পীড়িত। আজ দুপুর হইতে তাহার জ্বর হইয়াছিল বটে, কিন্তু ঘরে এমন এতটুকু কিছু ছিল না যে সে খায়। দুদিন শুধু জল খাইয়া আছে। জলে ভিজিয়া তহার শীত করিতে লাগিল, মাথা ঘুরিতে লাগিল, সে কোনোমতে হাতে পায়ে ভর দিয়া পৈঠা ছাড়িয়া চন্ডীমণ্ডপের ভিতরে ঢুকিয়া মাটির উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া মাথা খুড়িতে লাগিল।