মোহিনী তেমনই নতমুখে থাকিয়াই বলিল, পায়ে চটিজুতা ছিল—
বিরাজ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল—তাহার দুই চোখ দিয়া আগুন বাহির হইতে লাগিল। খানিক পরে চাপা বিকৃতকন্ঠে বলিল, জুতা দিয়ে মারলে! কি করে সহ্য করে রইলি ছোটবৌ?
ছোটবৌ একটুখানি মুখ তুলিয়া বলিল, আমার অভ্যাস হয়ে গেছে দিদি।
বিরাজ সে কথা যেন কানে শুনিতে পাইল না, তেমনই বিকৃত গলায় বলিল, আবার তারই জন্যে তুই মাপ চাইতে এলি?
ছোটবৌ বড়জার মুখপানে চাহিয়া বলিল, হাঁ দিদি। তুমি প্রসন্ন না হলে ওঁর অকল্যাণ হবে। আর, সহ্য করার কথা যদি বললে দিদি, সে তোমার কাছেই শেখা—আমার যা কিছু সবই তোমার পায়ে—
বিরাজ অধীর হইয়া উঠিল, না ছোটবৌ, না, মিছে কথা বলিস নে—এ অপমান আমি সইতে পারিনে।
ছোটবৌ একটুখানি হাসিয়া বলিল, নিজের অপমান সইতে পারাটাই খুব বড় পারা দিদি? তোমার মত স্বামী-সৌভাগ্য সংসারে মেয়েমানুষের অদৃষ্টে জোটে না, তবুও তুমি যা সয়ে আছ, সে সইতে গেলে আমরা গুঁড়ো হয়ে যাই। তাঁর মুখে হাসি নেই, মনের ভিতর সুখ নেই, তোমায় রাতদিন চোখে দেখতে হচ্চে; অমন স্বামীর অত কষ্ট সহ্য করতে তুমি ছাড়া আর কেঊ পারত না দিদি।
বিরাজ মৌন হইয়া রহিল।
ছোটবৌ খপ করিয়া হাত দিয়া তাহার পা দুটো চাপিয়া ধরিয়া বলিল, বল, ওঁকে ক্ষমা করলে? তোমার মুখ থেকে না শুনলে আমি কিছুতেই পা ছাড়ব না—তুমি প্রসন্ন না হ’লে ওঁকে কেউ রক্ষে করতে পারবে না দিদি !
বিরাজ পা সরাইয়া লইয়া হাত দিয়া ছোটবৌর চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিয়া বলিল, মাপ করলুম।
ছোটবৌ আর একবার পা’র ধূলা মাথায় লইয়া আনন্দিতমুখে চলিয়া গেল।
কিন্তু বিরাজ অভিভূতের মত সেইখানেই বহুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার হৃদয়ের অন্তস্তল হইতে কে যেন বারংবার ডাক দিয়া বলিতে লাগিল, এই দেখে শেখ বিরাজ!
সেই অবধি অনেকদিন পর্যন্ত ছোটবৌ এ বাড়িতে আসে নাই, কিন্তু একটি চোখ, একটি কান এই দিকেই পাতিয়া রাখিয়াছিল। আজ বেলা একটা বাজে, সে অতি সাবধানে এদিকে ওদিকে চাহিয়া এ বাড়িতে আসিয়া প্রবেশ করিল।
বিরাজ গালে হাত দিয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় একধারে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল, তেমনই করিয়া রহিল।
ছোটবৌ কাছে বসিয়া পায়ে হাত দিয়া নিজের মাথায় স্পর্শ করিয়া আস্তে আস্তে বলিল, দিদি কি পাগল হয়ে যাচ্চ?
বিরাজ মুখ ফিরাইয়া তীব্রকণ্ঠে উত্তর করিল, তুই হ’তিস নে?
ছোটবৌ বলিল, তোমার সঙ্গে তুলনা করে আমাকে অপরাধী ক’র না দিদি, এই দুটি পা’র ধূলোর যোগ্যও ত আমি নই, কিন্তু তুমি বল, কেন এমন কচ্চ? কেন, বঠ্ঠাকুরকে আজ খেতে দিলে না?
আমি ত খেতে বারণ করিনি!
ছোটবৌ বলিল, বারণ করনি সে কথা ঠিক, কিন্তু, কেন একবার গেলে না? তিনি খেতে বসে কতবার ডাকলেন। একটা সাড়া পর্যন্ত দিলে না। আচ্ছা তুমিই বল, এতে দুঃখ হয় কি না? একটিবার কাছে গেলে ত তিনি ভাত ফেলে উঠে যেতেন না।
তথাপি বিরাজ মৌন হইয়া রহিল।
ছোটবৌ বলিতে লাগিল, হাত-জোড়া ছিল ব’লে আমাকে ত ভুলাতে পারবে না দিদি! চিরকাল সমস্ত কাজ ফেলে রেখে তাঁকে সুমুখে বসে খাইয়েচ—সংসারে এর চেয়ে বড় কাজ তোমার কোনদিন ছিল না, আজ—
কথা শেষ না হইবার পূর্বেই বিরাজ উন্মাদের মত তাহার একটা হাত ধরিয়া সজোরে টান দিয়া বলিল, তবে দেখবি আয়। বলিয়া টানিয়া আনিয়া রান্নাঘরের মাঝখানে দাঁড় করাইয়া হাত দিয়া দেখাইয়া বলিল, ঐ চেয়ে দেখ্!
ছোটবৌ চাহিয়া দেখিল একটা কাল পাথরে অপরিষ্কৃত মোটা চালের ভাত এবং তাহারই একধারে অনেকটা কলমি-শাকসিদ্ধ, আর কিছুই নাই।
আজ কোন উপায় না দেখিয়া বিরাজ এইগুলি নদী হইতে ছিঁড়িয়া আনিয়া সিদ্ধ করিয়া দিয়াছিল।
দেখিতে দেখিতে ছোটবৌর দুচোখ বাহিয়া ঝরঝর করিয়া অশ্রু ঝরিয়া পড়িল, কিন্তু, বিরাজের চোখে জলের আভাস মাত্র নাই। দুই জায়ে নিঃশব্দে মুখোমুখি চাহিয়া রহিল।
বিরাজ অবিকৃতকন্ঠে বলিল, তুইও ত মেয়েমানুষ, তোকেও রেঁধে স্বামীর পাতে ভাত দিতে হয়, তুই বল্, পৃথিবীতে কেউ কি সুমুখে বসে স্বামীর ওই খাওয়া চোখে দেখতে পারে? আগে বল্, ব’লে যা, তোর মুখে যা আসে তাই ব’লে আমাকে গাল দে, আমি কথা ক’ব না।
ছোটবৌ একটি কথাও বলিতে পারিল না, তাহার চোখ দিয়া তেমনই অঝোরে জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।
বিরাজ বলিতে লাগিল, দৈবাৎ রান্নার দোষে যদি কোনদিন তাঁর একটি ভাতও কম খাওয়া হয়েছে, ত, সারাদিন বুকের ভিতর আমার কি ছুঁচ বিঁধেছে, সে আর কেউ না জানে ত তুই জানিস, ছোটবৌ, আজ তাঁর ক্ষিদের সময় আমাকে ঐ এনে দিতে হয়—তাও বুঝি আর জোটে না—
আর সে সহ্য করিতে পারিল না, ছোটজার বুকের উপর আছাড় খাইয়া পড়িয়া দুই হাতে গলা জড়াইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। তারপর, সহোদরার মত এই দুই রমণী বহুক্ষণ পর্যন্ত বাহুপাশে আবদ্ধ হইয়া রহিল, বহুক্ষণ ধরিয়া এই দুই অভিন্ন নারীহৃদয় নিঃশব্দে অশ্রুজলে ভাসিয়া যাইতে লাগিল।
তারপর বিরাজ মাথা তুলিয়া বলিল, না তোকে লুকাব না, কেননা, আমার দুঃখ বুঝতে তুই ছাড়া আর কেউ নেই। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমি সরে না গেলে ওঁর কষ্ট যাবে না। কিন্তু, থেকে ত ও-মুখ না দেখে একটা দিনও কাটাতে পারব না। আমি যাব, বল্ আমি গেলে ওঁকে দেখবি?
ছোটবৌ চোখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথা যাবে?
বিরাজের শুষ্ক ওষ্ঠাধরে কঠিন শীতল হাসির রেখা পড়িল, বোধ করি একবার সে দ্বিধাও করিল, তারপর বলিল, কি করে জানব বোন কোথায় যেতে হয়, শুনি ওর চেয়ে পাপ নাকি আর নেই, তা সে যাই হোক এ জ্বালা এড়াব ত!