বিরাজ ছুটিয়া আসিয়া রান্নাঘরে ঢুকিয়া কাঠের মূর্তির মত বসিয়া পড়িল।
নীলাম্বর এইমাত্র ঘুম ভাঙ্গিয়া বাহিরে আসিয়া মুখ ধুইতেছিল; পীতাম্বরের তর্জন ও প্রহারের শব্দ মুহূর্তকাল কান পাতিয়া শুনিল, এবং পরক্ষণেই বেড়ার কাছে আসিয়া লাথি মারিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া ও-বাড়িতে গিয়া দাঁড়াইল।
বেড়া ভাঙ্গার শব্দে পীতাম্বর চমকিয়া মুখ তুলিয়া সুমুখেই যমের মত বড়ভাইকে দেখিয়া বিবর্ণ হইয়া থামিল।
নীলাম্বর ভূ-শায়িতা ছোটবধূকে সম্বোধন করিয়া বলিল, ঘরে যাও মা, কোন ভয় নেই।
ছোটবৌ কাঁপিতে কাঁপিতে উঠিয়া গেলে নীলাম্বর সহজভাবে বলিল, বৌমার সামনে আর তোর অপমান করব না, কিন্তু, এই কথাটা আমার ভুলেও অবহেলা করিস নে যে, আমি যতদিন ও-বাড়িতে আছি ততদিন এ-সব চলবে না। যে হাতটা তুই ওর গায়ে তুলবি, তোর সেই হাতটা ভেঙ্গে দিয়ে যাব।—বলিয়া ফিরিয়া যাইতেছিল।
পীতাম্বর সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিয়া উঠিল, বাড়ি চ’ড়ে মারতে এলে, কিন্তু কারণ জান?
নীলাম্বর ফিরিয়া দাঁড়িইল, বলিল, না, জানতেও চাইনে।
পীতাম্বর বলিল, তা চাইবে কেন? আমাকে দেখচি তা হ’লে নিতান্তই ভিটে ছেড়ে পালাতে হবে।
নীলাম্বর তাহার মুখপানে অল্পক্ষণ চাহিয়া রহিল, পরে বলিল, ভিটে ছেড়ে কাকে পালাতে হবে, সে আমি জানি—তোকে মনে ক’রে দিতে হবে না। কিন্তু, যতক্ষণ তা না হচ্ছে, ততক্ষণ তোকে সবুর ক’রে থাকতেই হবে। সেই কথাটাই তোকে জানিয়ে গেলাম। বলিয়া আবার ফিরিবার উপক্রম করিতেই পীতাম্বর সহসা সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল; বলিল, তবে তোমাকে জানিয়ে দিই দাদা, পরকে শাসন করবার আগে ঘর শাসন করা ভাল।
নীলাম্বর চাহিয়া রহিল। পীতাম্বর সাহস পাইয়া বলিতে লাগিল, ও পারের ঘাটটা কার জান ত? বেশ। আমি সেই থেকে ছোটবৌকে ঘাটে যেতে মানা ক’রে দিই। আজ রাত থাকতে উঠে বৌঠানের সঙ্গে নাইতে গিয়েছিলেন—এমনই হয়ত রোজই যান, কে জানে!
নীলাম্বর আশ্চর্য হইয়া বলিল, এই দোষে গায়ে হাত তুললি?
পীতাম্বর বলিল, আগে শোন। ওই জমিদারের ছেলে—কি জানি, রাজেনবাবু না কি নাম ওর—দেশ-বিদেশে সুখ্যাতি ধরে না। আজ যে বৌঠান তার সঙ্গে আধঘন্টা ধ’রে গল্প করছিলেন, কেন?
নীলাম্বর বুঝিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, কে কথা কইছিল রে? বিরাজবৌ?
হাঁ, তিনিই।
তুই চোখে দেখেছিস?
পীতাম্বর মুখের ভাবটা হাসিবার মত করিয়া বলিল, তুমি আমাকে দেখতে পার না, জানি, —আমার সে বিচার সে নারায়ণ করবেন—কিন্তু—
নীলাম্বর ধমকাইয়া উঠিল, —আবার ঐ নাম মুখে আনে! কি বলবি বল।
পীতাম্বর চমকিয়া উঠিয়া ঈষৎ থামিয়া রুষ্টস্বরে বলিতে লাগিল, চোখে না দেখে কথা কওয়া আমার স্বভাব নয়। ঘর শাসন করতে না পার, পরকে তেড়ে মারতে এস না।
নীলাম্বরের মাথায় উপর অকস্মাৎ যেন বাড়ি পড়িল। ক্ষণকাল উদ্ভ্রান্তের মত চাহিয়া থাকিয়া শেষে প্রশ্ন করিল, আধঘন্টা ধরে গল্প করছিল, কে? বিরাজবৌ? তুই চোখে দেখেছিস? পীতাম্বর দু-এক পা ফিরিয়া গিয়াছিল, দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, চোখেই দেখেচি। আধঘন্টার হয়ত বেশী হতেও পারে।
আবার নীলাম্বর কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ভাল, তাই যদি হয়, কি করে জানলি তার কথা কইবার আবশ্যক ছিল না?
পীতাম্বর মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া বলিল, সে কথা জানি নে। তবে আমার মারধর করা উচিত হয়নি, কেননা ঘাট তৈরি ছোটবৌর জন্য হয়নি।
মুহূর্তের উত্তেজনায় নীলাম্বর দুই হাত তুলিয়া ছুটিয়া আসিয়াই থামিয়া পড়িল, তৎপরে পীতাম্বরের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, তুই জানোয়ার, তাতে ছোটভাই। বড়ভাই হ’য়ে আমি আর তোকে অভিসম্পাত করব না, আমি মাপ করলুম, কিন্তু আজ তুই যে-কথা গুরুজনকে বললি, ভগবান হয়ত তোকে মাপ করবেন না—যা, —বলিয়া সে ধীরে ধীরে এ-ধারে আসিয়া ভাঙ্গা বেড়াটা নিজেই বাঁধিয়া দিতে লাগিল।
বিরাজ কান পাতিয়া সমস্ত শুনিল। লজ্জায় ঘৃণায় তাহার আপাদমস্তক বারংবার শিহরিয়া উঠিতেছিল, একবার ভাবিল, সামনে গিয়া নিজের সব কথা বলে, কিন্তু, পা বাড়াইতে পারিল না। তাহার রূপের উপর পরপুরুষের লুব্ধদৃষ্টি পড়িয়াছে, স্বামীর সুমুখে এ কথা নিজের মুখে সে কি করিয়া উচ্চারণ করিবে!
বেড়া বাঁধিয়া দিয়া নীলাম্বর বাহিরে চলিয়া গেল।
দুপুরবেলা ভাত বাড়িয়া দিয়া বিরাজ আড়ালে বসিয়া রহিল, রাত্রে স্বামী ঘুমাইয়া পড়িলে নিঃশব্দে শয্যায় আসিয়া প্রবেশ করিল এবং প্রভাতে তাহার ঘুম ভাঙিবার পূর্বেই বাহির হইয়া গেল।
এমনি করিয়া পলাইয়া বেড়াইয়া যখন দু’দিন কাটিয়া গেল, অথচ নীলাম্বর কোন প্রশ্ন করিল না, তখন আর এক ধরনের আশঙ্কা তাহার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে মাথা তুলিতে লাগিল। স্ত্রী সম্বন্ধে এতবড় অপবাদের কথায় স্বামীর মনে কৌতূহল জাগে না, ইহার কোন সঙ্গত হেতু সে খুঁজিয়া পাইল না; কিংবা ঘটনাটায় তিনি বিস্মিত হইয়াছেন এ সম্ভাবনাও তাহাকে সান্ত্বনা দিতে পারিল না। এ দুইদিন একদিকে যেমন সে গা ঢাকিয়া ফিরিয়াছে, অপর দিকে তেমনই অনুক্ষণ আশা করিয়াছে, এইবার কথা উঠিবে; এইবার তিনি ডাকিয়া ঘটনাটি জানিতে চাহিবেন। তাহা হইলেই সে আনুপূর্বিক সমস্ত নিবেদন করিয়া স্বামীর পায়ের নীচে তাহার বুকের ভারী বোঝাটা নামাইয়া ফেলিয়া সুস্থ হইয়া বাঁচিবে, কিন্তু, কৈ কিছুই যে হইল না! স্বামী নির্বাক হইয়া রহিলেন।
একবার সে ভাবিবার চেষ্টা করিল, হয়ত কথাটা তিনি আদৌ বিশ্বাস করেন নাই, কিন্তু এই তাঁহার সম্পূর্ণ আত্মগোপন করাটাও কি তাঁহার চোখে পড়িয়া সংশয় উদ্রেক করিতেছে না! অথচ যাহা এতদিন পর্যন্ত সে গোপন করিয়া আসিয়াছে, তাহা নিজেই বা আজ যাচিয়া বলিবে কিরূপে? সেদিনটাও এমনই করিয়া কাটিল। পরদিন সকালে ভয়ার্ত ভাবাতুর হৃদয় লইয়া সে কোনমতে ঘরের কাজ করিতেছিল, হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর কথা তাহার বুকের গভীর তলদেশ আলোড়িত করিয়া ঘূর্ণাবর্তের মত বাহির হইয়া আসিল, আর যদি ঠাকুরপোর কথা বিশ্বাস করেই থাকেন, তা হ’লে?