তবুও নীলাম্বর ভাবিতেছিল—এ কথা বিরাজ মুখে আনিল কি করিয়া! সে তাহাকে মারধর করিতেও পারে, তাহার সম্বন্ধে এত বড় হীন ধারণা তাহার জন্মিল কেন? একে ত সংসারে দুঃখ-কষ্টের অবধি নাই, তাহার উপর প্রতিদিন এ কি হইতে লাগিল? দু’দিন যায় না, বিবাদ বাধে, কথায় কথায় মনোমালিন্য, চোখে চোখে কলহ, পদে পদে মতভেদ হয়। সর্বোপরি তাহার এমন বিরাজ দিন দিন এমন হইয়া যাইতে লাগিল—অথচ কোন দিকে চাহিয়া সে এই দুঃখের সাগরের কিনারা দেখিল না। নীলাম্বরের ভগবানের চরণে অচলা ভক্তি ছিল, অদৃষ্টের লেখায় অসীম বিশ্বাস ছিল, সে সেই কথাই ভাবিতে লাগিল, কাহাকেও মনে মনে দোষ দিল না, কাহারও নিন্দা করিল না—চন্ডীমণ্ডপের দেয়ালে টাঙ্গানো রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির সুমুখে দাঁড়াইয়া ক্রমাগত কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, ভগবান, যদি এত দুঃখেই ফেলবে মনে ছিল, তবে এতবড় নিরূপায় করে আমাকে গড়লে কেন? সে যে কত নিরুপায়, সে কথা তাহার অপেক্ষা বেশী আর কেহই জানে না। লেখাপড়া শিখে নাই, কোন রকমের কাজকর্ম জানিত না, জানিত শুধু দুঃখীর সেবা করিতে, শিখিয়াছিল শুধু ভগবানের নাম করিতে। তাহাতে পরের দুঃখ ঘুচিত বটে, কিন্তু অসময়ে আজ নিজের দুঃখ ঘুচিবে কি করিয়া! আর তাহার কিছুই নাই—সমস্ত গিয়াছে। তাই, দুঃখের জ্বালায় কতদিন সে মনে মনে ভাবিয়াছে, এখানে আর থাকিবে না, বিরাজকে লইয়া যেখানে দু’চোখ যায় যাইবে; কিন্তু এই সাত-পুরুষের ভিটা ছাড়িয়া কোন্ দেব-মন্দিরের দ্বারে বসিয়া, কোন্ গাছের তলায় শুইয়া সে সুখ পাইবে! এই ক্ষুদ্র নদী, এই গাছপালায় ঘেরা বাড়ি, এই ঘরে-বাহিরে আজন্মপরিচিত লোকের মুখ—সমস্ত ছাড়িয়া সে কোন্ দেশে, কোন্ স্বর্গে গিয়া একটা দিনও বাঁচিবে! এই বাটীতে তাহার মা মরিয়াছে, এই চন্ডীমন্ডপে সে তাহার মুমূর্ষু পিতার শেষ সেবা করিয়া গঙ্গায় দিয়া আসিয়াছে—এইখানে সে পুঁটিকে মানুষ করিয়াছে, তাহার বিবাহ দিয়াছে—এই ঘরবাড়ির মায়া সে কেমন করিয়া কাটাইবে! সে সেইখানে বসিয়া পড়িয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া রুদ্ধস্বরে কাঁদিতে লাগিল। আর এই কি তাহার সব দুঃখ? তাহার বোনটিকে সে কোথায় দিয়া আসিল তাহার একটা সংবাদ পর্যন্ত পাওয়া যাইতেছে না; কতদিন হইয়া গেল, তাহার মুখ দেখে নাই, তাহার-সুতীক্ষ্ণ কন্ঠের ‘দাদা’ ডাক শুনিতে পায় নাই—পরের ঘরে সে কি দুঃখ পাইতেছে, কত কান্না কাঁদিতেছে, কিছুই সে জানিতে পারে নাই। অথচ বিরাজের কাছে তাহার নামটি পর্যন্ত করিবার জো নাই। সে তাহাকে মানুষ করিয়াও এমন করিয়া ভুলিতে পারিল, কিন্তু সে ভুলিবে কি করিয়া? তাহার মায়ের পেটের বোন, হাতে কাঁখে করিয়া বড় করিয়াছে, যেখানে গিয়াছে সঙ্গে করিয়া গিয়াছে—সেজন্য কত কথা, কত উপহাস সহ্য করিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই পুঁটিকে কাঁদাইয়া রাখিয়া ঘর ছাড়িয়া এক পা যাইতে পারে নাই। এ-সব কথা শুধু সে জানে, আর সেই ছোটবোনটি জানে।
বিরাজ জানিয়াও জানে না। একটা কথা পর্যন্ত বলে না। পুঁটির সম্বন্ধে সে যেন পাষাণমূর্তির মত একেবারে চিরদিনের জন্য নির্বাক হইয়া গিয়াছে। সে যে মনে মনে তাহার সেই নিরপরাধা বোনটিকে অপরাধী করিয়া রাখিয়াছে, এ চিন্তা তাহাকে শূলের মত বিঁধিত; কিন্তু এ সম্বন্ধে একবিন্দু আলোচনার পথ পর্যন্ত ছিল না।
কোন একটা কথা বলিতে গেলেই বিরাজ থামাইয়া দিয়া বলে, ও-সব কথা থাক—সে রাজরানী হোক, কিন্তু তার কথায় কাজ নেই। এই ‘রাজরানী’ কথাটা বিরাজ এমনভাবে উচ্চারণ করিয়া উঠিয়া যাইত যে, নীলাম্বরের বুকের ভিতরটা জ্বালা করিতে থাকিত। পাছে তাহার উপর গুরুজনের অভিসম্পাত পড়ে, পাছে কোন অকল্যাণ হয়, এই আশঙ্কায় সে মনে মনে ব্যাকুল হইয়া উঠিত, ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করিত, লুকাইয়া ‘হরির লুঠ’ দিয়া নদীতে ভাসাইয়া দিত। এমনই করিয়া তাহার দিন কাটিতেছিল।
দুর্গাপূজা আসিয়া পড়িল। সে আর থাকিতে না পারিয়া গোপনে ক’একটা টাকা সংগ্রহ করিয়া একখানি কাপড় ও কিছু মিষ্টান্ন কিনিয়া সুন্দরীকে গিয়া ধরিল।
সুন্দরী বসিতে আসন দিল, তামাক সাজিয়া দিল। নীলাম্বর আসন গ্রহণ করিয়া তাহার জীর্ণ মলিন উত্তরীয়ের ভিতর হইতে সেই কাপড়খানি বাহির করিয়া বলিল, তুই ত তাকে মানুষ করেচিস সুন্দরী, যা একবার দেখে আয়। আর সে বলিতে পারিল না, মুখ ফিরাইয়া চাদরে চোখ মুছিল।
সুন্দরী ইহাদের কষ্টের কথা জানিত। গ্রামের সকলেই জানিত। কহিল, সে কেমন আছে বড়বাবু?
নীলাম্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিল, জানিনে।
সুন্দরীর বুদ্বি-বিবেচনা ছিল, সে আর প্রশ্ন করিল না। পরদিন সকালেই যাইবে জানাইতে নীলাম্বর কিছু পাথেয় দিতে গেল, সুন্দরী তাহা গ্রহণ করিল না; কহিল, না বড়বাবু, তুমি কাপড় কিনে ফেলেচ, না হলে এও আমি নিয়ে যেতাম না—তোমার মত আমিও যে তাকে মানুষ করেচি।
নীলাম্বরের চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল, সে মুখ ফিরাইয়া ক্রমাগত চোখ মুছিতে লাগিল। এমন একটা সমবেদনার কথা সে কাহারও কাছে পায় নাই। সবাই কহে, সে ভুল করিয়াছে, অন্যায় করিয়াছে, পুঁটি হইতেই তাহার সর্বনাশ হইয়াছে। উঠিবার উদ্যোগ করিয়া সে সুন্দরীকে বিশেষ করিয়া সাবধান করিয়া দিল যেন এই সব দুঃখ-কষ্টের কথা পুঁটি কোনমতে না জনিতে পারে।
নীলাম্বর চলিয়া গেল, সুন্দরীও এইবার একফোঁটা চোখের জল আঁচলে মুছিল। এই লোকটিকে মনে মনে সবাই ভালবাসিত, সবাই ভক্তি করিত।