শুনিয়া বন্দনা হাসিল। কহিল, দ্বিজুবাবু, এ আপনার রাগের কথা। নইলে যে অর্থ আপনাদের আছে তাতে শুধু নিজে নয়, ইচ্ছে করলে এ গ্রামের অর্ধেক লোককে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। বেশ, সে ব্যবস্থা আমি করে দিচ্চি, আপনি যাবার জন্য প্রস্তুত হোন।
দ্বিজু কহিল, সে ব্যবস্থা হবার নয়। টাকা প্রচুর আছে সত্যি, কিন্তু সে-সব দাদার, আমার নয়। আমি দয়ার ওপর আছি বললেও অত্যুক্তি হয় না।
বন্দনা পুনরায় হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, অত্যুক্তি যে কি এবং কোন্টা, সে আমিও বুঝি। কিন্তু এও রাগের কথা। মেজদির চিঠিতে একবার শুনেছিলাম যে, যে সম্পত্তি আপনি নিজে অর্জন করেন নি সে নিতে আপনি অনিচ্ছুক। এ কথা কি ঠিক নয়?
দ্বিজদাস বলিল, যদি ঠিকও হয়, সে মানুষের ধর্মবুদ্ধির কথা, রাগের নয়। কিন্তু এ-ই সমস্ত কারণ নয়।
সমস্ত কারণটা কি শুনতে পাইনে?
দ্বিজদাস চুপ করিয়া রহিল। বন্দনা ক্ষণকাল তাহার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি স্বভাবতঃ এত কৌতূহলী নই এবং আমার এই আগ্রহ যে সৃষ্টিছাড়া আতিশয্য যে বোধ আমারও আছে, কিন্তু বোধ থাকলেই সংসারের সব প্রয়োজন মেটে না—অভাব হাঁ করে চেয়ে থাকে। আপনার কথা আমি এত বেশী শুনেচি যে, আপনি প্রথম যখন ঘরে ঢুকলেন অপরিচিত বলে আপনাকে মনেই হ’ল না, যেন কতবার দেখেচি এমনি সহজে চিনতে পারলুম। মেজদিকে এত কথা বলতে পেরেচেন, আর আমাকে পারেন না? আর কিছু না হোক, তাঁর মত আমিও ত একজন আত্মীয়।
কথা শুনিয়া দ্বিজু অবাক হইয়া গেল। এবং অকস্মাৎ সমস্ত ব্যাপারটা মনে পড়িয়া তাহার সঙ্কোচ ও বিস্ময়ের অবধি রহিল না। সম্পূর্ণ অচেনা বয়স্থা কন্যার সহিত নির্জনে এইভাবে আলাপ করার ইতিহাস এই প্রথম, দেয়ালে ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিল, একঘণ্টারও উপর কাটিয়া গেছে, ইতিমধ্যে নীচে কেহ যদি তাহাদের খুঁজিয়া থাকে, এ বাটীতে তাহার জবাব যে কি, সে ভাবিয়া পাইল না। হয়ত দাদা বাড়ি ফিরিয়াছেন, হয়ত মায়ের আহ্নিক সারা হইয়াছে,—হঠাৎ সমস্ত দেহ-মন তাহার ব্যাকুল হইয়া যেন একমুহূর্তে সিঁড়ির দিকে ছুটিয়া গেল, কিন্তু কিছুই করিতে না পারিয়া তেমনি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।
কৈ, বললেন না? বলুন?
দ্বিজুর চমক ভাঙ্গিল। কহিল, যদি বলি, আপনাকেই প্রথম বলব। বৌদিকেও আজও বলিনি।
সে বোঝাপড়া তিনি করবেন। আমি কিন্তু না শুনে,—
বলা যে উচিত নয় এ-সম্বন্ধে দ্বিজুর সংশয় ছিল না, কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করারও তাহার শক্তি রহিল না।
হতবুদ্ধির মত মিনিট-খানেক চাহিয়া থাকিয়া কহিল, বাবা আমাকে বস্তুতঃ কিছুই দিয়ে যাননি।
বন্দনা চমকিয়া উঠিল, —ইস! মিছে কথা। এ হতেই পারে না।
প্রত্যুত্তরে দ্বিজু মাথা নাড়িয়া শুধু জানাইল, —পারে।
কিন্তু তার কারণ?
বাবার বোধ হয় ধারণা জন্মেছিল, আমাকে দিলে সম্পত্তি তাঁর নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এ ধারণার কোন সত্যিকার হেতু ছিল?
ছিল। আমাকে বাঁচাবার জন্যে একবার তাঁর বহু টাকা নষ্ট হয়ে গেছে।
বন্দনার মনে পড়িল এই ধরনের একটা ইঙ্গিত একবার সতীর চিঠির মধ্যে ছিল। জিজ্ঞাসা করিল, বাবা উইল করে গেছেন?
দ্বিজদাস কহিল, এ শুধু দাদাই জানেন। তিনি বলেন,—না।
বন্দনা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তবু রক্ষে। আমি ভেবেচি বুঝি তিনি সত্যিই উইল করে আপনাকে বঞ্চিত করে গেছেন।
দ্বিজদাস কহিল, তাঁর নিজের ইচ্ছের অভাব ছিল না, কিন্তু মনে হয় দাদা করতে দেননি।
দাদা করতে দেননি। আশ্চর্য!
দ্বিজু হাসিয়া বলিল, দাদাকে জানলে আর আশ্চর্য মনে হবে না। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, ঘরে তখনো চাকরে আলো দিয়ে যায়নি, আমি পাশের ঘরে একটা বই খুঁজছিলাম, হঠাৎ বাবার কথা কানে গেল। দাদা বললেন, না। বাবা জিদ করতে লাগলেন, না কেন বিপ্রদাস? আমার পিতা-পিতামহকালের সম্পত্তি আমি নষ্ট হতে দিতে পারব না। পরলোকে থেকেও আমি শান্তি পাব না। তবুও দাদা জবাব দিলেন, না, সে কোনমতেই হতে পারে না। বাবা বললেন, তবুও তোমারি হাতে আমি সমস্ত রেখে গেলাম। যদি ভাল মনে কর দিয়ো, যদি তা না মনে করতে পার, তাকে দিয়ো না। এর পরেও বাবা দু-তিন বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেন নি।
বন্দনা মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, এ কথা আর কেউ জানে?
কেউ না। শুধু আমি জানি লুকিয়ে শুনেছিলাম বলে।
বন্দনা বহুক্ষণ নীরবে থাকিয়া অস্ফুটে কহিল, সত্যই আপনার দাদা অসাধারণ মানুষ।
দ্বিজদাস শান্তভাবে শুধু বলিল, হাঁ। কিন্তু এখন আমি নীচে যাই, আমার অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। আপনি বসে বসে বই পড়ুন যতক্ষণ না ডাক পড়ে।
বন্দনা হাসিয়া কহিল, এখন বই পড়বার রুচি নেই, চলুন আমিও যাই। অন্ততঃ আট-দশদিন ত এখানে আছি, – বই পড়বার অনেক সময় পাব।
দ্বিজদাস চলিতে উদ্যত হইয়াছিল, থমকিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার বাবার সঙ্গে আজ কলকাতা যাবেন না?
না। তাঁর ফেরবার পথে বোম্বায়ে চলে যাব।
দ্বিজদাস কহিল, বরঞ্চ আমি বলি তাঁর ফেরবার পথেই আপনি কিছুদিন এখানে থেকে যাবেন।
বন্দনা কহিল, প্রথমে সেই ইচ্ছেই ছিল, কিন্তু এখন দেখচি তাতে ঢের অসুবিধে। আমাকে পৌঁছে দেবার কেউ নেই। কিন্তু আপনি যদি রাজী হন, আপনার পরামর্শই শুনি।
কিন্তু আমি ত তখন থাকব না। এই সোমবারে মাকে নিয়ে কৈলাস তীর্থে যাত্রা করব।
বন্দনার দুই চক্ষু আনন্দে ও উৎসাহে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল—কৈলাস? কৈলাসে যাবেন? শুনেচি সে নাকি এক পরমাশ্চর্য বস্তু। সঙ্গে আপনাদের আর কে কে যাবেন?