মেয়ে মুচকিয়া হাসিয়া ঘাড় নাড়িল, কহিল, তুমি খুঁজে খুঁজে সারাদিন পড় বাবা, আমার একটুও তাড়াতাড়ি নেই। দ্বিজদাসকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, মেজদির মুখে শুনেচি আপনার মস্ত লাইব্রেরি আছে, বরঞ্চ সেইখানে চলুন, দেখি গে আপনার কত বই জমেছে।
চলুন।
লাইব্রেরি ঘরটা তেতলায়। মস্ত চওড়া সিঁড়ি, উঠিতে উঠিতে দ্বিজদাস কহিল, লাইব্রেরি বেশ বড়ই বটে, কিন্তু আমার নয়, দাদার। আমি শুধু কোথায় কি বই বেরুলো সন্ধান নিই এবং হুকুম মত কিনে এনে দিই।
কিন্তু পড়েন ত আপনি?
সে কিছুই নয়। পড়েন যাঁর লাইব্রেরি তিনি স্বয়ং। আশ্চর্য শক্তি এবং তেমনি অদ্ভুত মেধা তাঁর।
কে? দাদা!
হ্যাঁ। ইউনিভারসিটির ছাপছোপ বিশেষ-কিছু তাঁর গায়ে লাগেনি সত্যি, কিন্তু মনে হয় এত বড় বিরাট পাণ্ডিত্য এদেশে কম লোকেরই আছে। হয়ত নেই। আপনার ভগিনীপতি তিনি, কখন দেখেন নি তাঁকে?
না। কিরকম দেখতে?
ঠিক আমার উলটো। যেমন দিন আর রাত। আমি কালো, তাঁর বর্ণ সোনার মত। গায়ের জোর তাঁর এ অঞ্চলে বিখ্যাত। লাঠি, তলোয়ার, বন্দুকে এদিকে তাঁর জোড়া নেই। একা মা ছাড়া তাঁর মুখের পানে চেয়ে কথা কইতেও কেউ সাহস করে না।
বন্দনা হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার মেজদিও না?
দ্বিজদাস বলিল, না, আপনার মেজদিও না।
ভয়ানক বদরাগী বুঝি?
না, তাও না। ইংরেজীতে যে অ্যারিস্টোক্র্যাট বলে একটা কথা আছে, আমার দাদা বোধ করি কোন জন্মে তাদেরই রাজা ছিলেন। অন্ততঃ আমার ধারণা তাই। বদরাগী কি না জিজ্ঞেসা করছিলেন? কোনরকম রাগারাগি করবার তাঁর অবকাশই হয় না।
বন্দনা কহিল, দাদার ওপর আপনার ভয়ানক ভক্তি? না?
দ্বিজদাস চুপ করিয়া রহিল। খানিক পরে বলিল, এ কথার জবাব যদি কখনো সম্ভব হয় আপনাকে আর একদিন দেব।
বন্দনা সবিস্ময়ে কহিল, তার মানে?
দ্বিজদাস ঈষৎ হাসিয়া বলিল, মানে যদি এখনই বলি, আর একদিন জবাব দেবার প্রয়োজনই হবে না। আজ থাক।
মস্ত লাইব্রেরি। যেমন মূল্যবান আলমারি টেবিল চেয়ার প্রভৃতি আসবাব, তেমনি সুশৃঙ্খলায় পরিপাটি করিয়া সাজান। পল্লীগ্রামে এত বড় একটা বিরাট কাণ্ড দেখিয়া বন্দনা আশ্চর্য হইয়া গেল। বোম্বাই শহরে এ বস্তুর অভাব নাই, সে তুলনায় এ হয়ত তেমন কিছু নয়, কিন্তু পল্লীগ্রামে বাস করিয়া কোন একজনের নিছক নিজের জন্য এত অধিক সঞ্চয় সত্যই বিস্ময়ের ব্যাপার। জিজ্ঞাসা করিল, বাস্তবিক এত বই দাদা পড়েন নাকি?
দ্বিজদাস বলিল, পড়েন এবং পড়েছেন। আলমারি বন্ধ নয়, কোন একটা বই খুলে দেখুন না, তাঁর পড়ার চিহ্ন হয়ত চোখে পড়বে।
এত সময় পান কখন? দিন-রাত শুধু এই-ই করেন নাকি?
দ্বিজু ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। অন্ততঃ আমি ত জানিনে। তা ছাড়া আমাদের বিষয়-সম্পত্তি ভীষণ কিছু একটা না হলেও নিতান্ত কমও নয়। তার কোথায় কি আছে এবং হচ্চে সমস্ত দাদার চোখের ওপর। কেবল আজ বলে নয়, বাবা বেঁচে থাকতেও এই ব্যবস্থাই বরাবর আছে। সময় পাবার রহস্য আমিও ঠিক খুঁজে পাইনে, আপনার মত আমার বিস্ময়ও কম নয়, তবে শুধু এই ভাবি যে জগতে মাঝে মাঝে দু-একজন জন্মায় তারা সাধারণ মানুষের হিসাবের বাইরে। দাদা সেই জাতীয় জীব। আমাদের মত হয়ত এঁদের কষ্ট করে পড়তেও হয় না, ছাপার অক্ষর চোখের মধ্যে দিয়ে আপনিই গিয়ে মগজে ছাপ মেরে দেয়। কিন্তু দাদার কথা এখন থাক। আপনি তাঁকে এখনো চোখে দেখেন নি, আমার মুখে একতরফা আলোচনা অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে।
কিন্তু আমার শুনতে খুব ভালই লাগচে।
কিন্তু কেবল ভাল-লাগাটাই ত সব নয়। পৃথিবীতে আমরাও অত্যন্ত সাধারণ আরও দশজন ত আছি। একটি মাত্র অসাধারণ ব্যক্তিই যদি সমস্ত জায়গা জুড়ে বসে, আমরা যাই কোথা? ভগবান মুখটা ত কেবল পরের স্তব গাইতেই দেননি?
বন্দনা সহাস্যে কহিল, অর্থাৎ দাদাকে ছেড়ে এখন ছোটভাইয়ের একটু স্তব গাইতে চান;—এই ত?
দ্বিজুও হাসিল, কহিল, চাই ত বটে, কিন্তু সুযোগ পাই কোথায়? যারা পরিচিত তারা কান দেবে না, অচেনার কাছেই একটু গুনগুন করা চলে কিন্তু সাহস পাইনে, ভয় হয় অভ্যাসের অভাবে নিজের স্তব নিজের মুখে হয়ত বেধে-বেধে যাবে।
বন্দনা বলিল, না যেতেও পারে, চেষ্টা করে দেখুন। আমার বিশ্বাস পুরুষেরা এ বিদ্যেয় আজন্মসিদ্ধ। আর দেরি করবেন না, আরম্ভ করুন।
দ্বিজু মাথা নাড়িয়া কহিল, না, পেরে উঠব না। তার চেয়ে বরঞ্চ নিরিবিলি বসে দু-চারখানা বই দেখুন, আমি বৌদিকে পাঠিয়ে দিচ্চি। এই বলিয়া সে চলিয়া যাইতে উদ্যত হইতেই বন্দনা জোর দিয়া বলিয়া উঠিল, বেশ ত আপনি! না, একলা ফেলে আমাকে যাবেন না। বই আমি অনেক পড়েচি, তার দরকার নেই। আপনি গল্প করুন আমি শুনি।
কিসের গল্প?
আপনার নিজের।
তা হলে একটু সবুর করুন, আমি এক্ষুনি নীচে গিয়ে ঢের ভাল বক্তা পাঠিয়ে দিচ্চি।
বন্দনা বলিল, পাঠাবেন মেজদিকে ত? তার দরকার নেই। তাঁর বলবার যা-কিছু ছিল চিঠিতেই শেষ হয়ে গেছে। সেগুলো সত্যি কিনা এখন তাই শুনতে চাই।
দ্বিজদাস বলিল, না, সত্যি নয়। অন্ততঃ বারো-আনা মিথ্যে। আচ্ছা, আপনি নাকি শীঘ্রই বিলেতে যাচ্চেন?
বন্দনা বুঝিল, এই লোকটি নিজের প্রসঙ্গ আলোচনা করিতে চায় না এবং জিদ করার মত ঘনিষ্ঠতা অশোভন হইবে। কহিল, বাবার ইচ্ছে তাই। ইস্কুলের বিদ্যেটা তিনি সেখানে গিয়েই শেষ করতে বলেন। আপনিও কেন চলুন না?
দ্বিজদাস বলিল, আমার নিজের আপত্তি নেই, কিন্তু টাকা পাব কোথায়? সেখানে ছেলে পড়িয়েও চলবে না, এবং এত ভার বৌদির ওপরেও চাপাতে পারব না। এ আশা বৃথা।