মাসী মনে মনে বলিলেন, আর একটা স্টুপিড সেন্টিমেন্টালিটি। সাহেব অনুমান করিলেন কিনা জানি না, কিন্তু এবার জোর করিয়া একটু ম্লান হাসিয়া বলিলেন, মুশকিল হয়েছে ওর কথা আমরা কেউ ভালো বুঝতে পারিনে। শুধু আজ নয়, বাঙলা থেকে আসা পর্যন্তই মনে হয় ঠিক যেন ওকে বুঝতে পারিনে। ও সম্মতি দিলে বটে, কিন্তু সে-ও, না ওর নতুন রিলিজন ভেবেই পেলুম না।
নতুন রিলিজন? মানে?
মানে আমিও জানিনে। কিন্তু বেশ দেখতে পাই বাঙলা থেকে ও কি যেন একটা সঙ্গে করে এনেছে, সে রাত্রি-দিন থাকে ওকে ঘিরে। ওর খাওয়া গেছে বদলে, কথা গেছে বদলে, ওর চলা-ফেরা পর্যন্ত মনে হয় যেন আগেকার মতো নেই। ভোরবেলায় স্নান করে আমার ঘরে গিয়ে পায়ের ধুলো মাথায় নেয়। বলি, বুড়ী, আগে ত তুই এ-সব করতিস নে?
তখন জানতুম না বাবা। এখন তোমার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে দিন আরম্ভ করি, বেশ বুঝতে পারি সে আমাকে সমস্ত দিন সমস্ত কাজে রক্ষে করে চলে। বলিতে বলিতে তাঁহার চক্ষু পুনরায় অশ্রুসজল হইয়া উঠিল।
মাসী মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন, এ-সব নতুন ধাঁচা শিখে এসেছে ও মুখুয্যেদের বাড়িতে। জানেন ত তাঁরা কি রকম গোঁড়া। কিন্তু একে রিলিজন বলে না, বলে কুসংস্কার। ও পূজোটুজো করে নাকি?
সাহেব বলিলেন, জানিনে করে কিনা। হয়ত করে না। কুসংস্কার বলে আমারও মনে হয়েছে, নিষেধ করতেও গেছি, কিন্তু বুড়ী আগেকার মতো আর ত তর্ক করে না, শুধু চুপ করে চেয়ে থাকে। আমারও মুখ যায় বন্ধ হয়ে—কিছুই বলতে পারিনে।
মাসী বলিলেন, এ আপনার দুর্বলতা। কিন্তু নিশ্চিত জানবেন একে রিলিজন বলে না, বলে শুধু সুপারস্টিশন। একে প্রশ্রয় দেওয়া অন্যায়! অপরাধ!
সাহেব দ্বিধাভরে আস্তে আস্তে বলিলেন, তাই হবে বোধ হয়। রিলিজন কথাটা মুখেই বলি, কখনো নিজেও চর্চা করিনি, এর নেচার কি তা—ও জানিনে, শুধু মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি মেয়েটাকে এমন আগাগোড়া বদলে দিলে কিসে? সে হাসি নেই, আনন্দের চঞ্চলতা নেই, বর্ষাদিনের ফুটন্ত ফুলের মতো পাপড়িগুলি যেন জলে ভিজে। কখনো ডেকে বলি, বুড়ী, আমাকে লুকোস নে মা, তোর ভেতরে ভেতরে কোন অসুখ করেনি ত? অমনি হেসে মাথা দুলিয়ে বলে, না বাবা, আমি ভালো আছি, আমার কোন অসুখ নেই। হাসিমুখে ঘরের কাজে চলে যায়, আমার কিন্তু বুকের পাঁজর ভেঙ্গে পড়তে চায় মিসেস ঘোসাল। ঐ একটি মেয়ে, মা নেই, নিজের হাতে মানুষ করে এতবড়টি করেছি,—সর্বস্ব দিয়েও যদি আমার সেই বন্দনাকে আবার তেমনি ফিরে পাই—
মাসী জোর দিয়া বলিলেন, পাবেন। আমি কথা দিচ্চি পাবেন। এ শুধু একটা সাময়িক অবসাদ, ধর্মের ঝোঁক হলেও হতে পারে, কিন্তু অত্যন্ত অসার। কেবল ওঁদের সংসর্গে আসার ক্ষণিক বিকার। বিবাহ দিন, সমস্ত দুদিনে সেরে যাবে। চিরদিনের শিক্ষাই মানুষের থাকে মিস্টার রে, দু দিনের বাতিক দু দিনেই ফুরোয়।
সাহেব আশ্বস্ত হইলেন, তথাপি সন্দেহ ঘুচিল না। বলিলেন, ও কোথায় কার কাছে কি প্রেরণা পেলে জানিনে, কিন্তু শুনেচি সে যদি আসে সত্যিকার মানুষ থেকে কিছুতে সে ঘোচে না। মানুষের চিরদিনের অভ্যাস দেয় একমুহূর্তে বদলে। নেশা গিয়ে মেশে রক্তের ধারায়, সমস্ত জীবনে তার আর ঘোর কাটে না। সেই আমার ভয় মিসেস ঘোষাল।
প্রত্যুত্তরে মাসী একটু অবজ্ঞার হাসি হাসিলেন, বলিলেন, বাজে বাজে। আমি অনেক দেখেছি মিস্টার রে—দুদিন পরে আর কিছুই থাকে না। আবার যাকে তাই হয়। কিন্তু বাড়তে দেওয়াও চলবে না,—আজই অশোককে একটা তার করে দিই—সে এসে পড়ুক।
আজই দেবেন?
হাঁ, আজই। এবং আপনার নামেই।
সাহেব মৃদুকণ্ঠে সম্মতি জানাইয়া বলিলেন, যা ভালো হয় করুন। আমি জানি অশোক ভালো ছেলে। চরিত্রবান, সৎ—তা নইলে ওকে সঙ্গে নিয়ে বন্দনা কিছুতে আসতে রাজী হতো না।
মাসী এই কথাটাকেই আর একবার ফাঁপাইয়া ফুলাইয়া বলিতে গেলেন, কিন্তু বাধা পড়িল। বন্দনা ঘরে ঢুকিয়া বলিল, বাবা, আজ হাজি-সাহেবের মেয়েরা আমাকে চায়ের নেমন্তন্ন করেছে। দুপুরবেলা যাবো,—বিকালে আফিসের ফেরত আমাকে বাড়ি নিয়ে এসো।
মাসী প্রশ্ন করিলেন, তাঁদের বাড়িতে তুমি ত কিছু খাবে না বন্দনা?
না মাসীমা।
কেন?
আমার ইচ্ছে করে না। বাবা, তুমি ভুলে যাবে না ত?
না মা, তোমাকে আনতে ভুলে যাবো এমন কখন হয়? এই বলিয়া সাহেব একটু হাসিলেন। বলিলেন, অশোক আসচেন। তাঁকে আজ একটা তার করে দেবো।
বেশ ত বাবা, দাও না।
মাসী বলিলেন, আমিই জোর করে তাকে আনচি। দেখো, এলে যেন না অসম্মান হয়।
তোমার ভয় নেই মাসীমা, আমরা কারো অসম্মান করিনে। অশোকবাবু নিজেই জানেন।
মেয়ের কথা শুনিয়া সাহেব প্রসন্নমুখে বলিলেন, আফিসের পথে আজই তাকে একটা টেলিগ্রাম করে দেবো বুড়ী। আজ শুক্রবার, সোমবারেই সে এসে পৌঁছতে পারবে যদি না কোন ব্যাঘাত ঘটে।
দরোয়ান ডাক লইয়া হাজির হইল। অসংখ্য সংবাদপত্র নানা স্থানের। চিঠিপত্রও কম নয়। কিছুদিন হইতে ডাকের প্রতি বন্দনার ঔৎসুক্য ছিল না। সে জানিত প্রতিদিন আশা করিয়া অপেক্ষা করা বৃথা। তাহাকে মনে করিয়া চিঠি লিখিবার কেহ নাই। চলিয়া যাইতেছিল, সাহেব ডাকিয়া বলিলেন, এই যে তোমার নামের দু-খানা। আপনারও একখানা রয়েছে মিসেস ঘোষাল।
নিজের চেয়েও পরের চিঠিতে মাসীর কৌতূহল বেশি। মুখ বাড়াইয়া দেখিয়া বলিলেন, একখানা ত দেখচি অশোকের হাতের লেখা। ওটা কার?