রে-সাহেব মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিলেন, খুব সত্যি মিসেস ঘোষাল।
মাসী তাঁহাকেই উদ্দেশ করিয়া বলিতে লাগিলেন, আজ ওর মা বেঁচে থাকলে বন্দনার জন্যে আপনাকে তিনি অস্থির করে তুলতেন। আমি নিজেই কি কম করেছি ওঁকে। এখন মনে করলেও লজ্জা হয়।
সাহেব সায় দিয়া বলিলেন, দোষ নেই আপনার। ঠিক এমনিই হয় যে।
মাসী বলিতে লাগিলেন, তাই ত জানি। কেবলি ভাবনা হয় নিজেদের বয়েস বাড়চে,—মানুষের বেঁচে থাকার ত স্থিরতা নেই—বেঁচে থাকতে মেয়েটার যদি না কোন উপায় করে যেতে পারি হঠাৎ কিছু ঘটলে কি হবে। ভয়ে উনি ত একরকম শুকিয়ে উঠেছিলেন।
বন্দনা আর সহিতে পারিল না, চাহিয়া দেখিল তাহার বাবার মুখও শুকাইয়া উঠিয়াছে, খাওয়া বন্ধ হইয়াছে, বলিল, তুমি মেসোমশাইকে অকারণে নানা ভয় দেখিয়েচো মাসীমা, আবার আমার বাবাকেও দেখাচ্চো। কি এমন হয়েছে বলো ত? বাবা এখনো অনেকদিন বাঁচবেন। তাঁর মেয়ের জন্যে যা ভালো, করে যাবার ঢের সময় পাবেন। তুমি মিথ্যে ভাবনা বাড়িয়ে দিও না বাবার।
মাসী দমিবার পাত্রী নহেন। বিশেষতঃ রে-সাহেব তাঁহাকেই সমর্থন করিয়া বলিলেন, তোমার মাসীমা ঠিক কথাই বলেছেন বন্দনা। সত্যিই ত আমার শরীর ভালো নয়, সত্যিই ত এ দেহকে বেশী বিশ্বাস করা চলে না। উনি আত্মীয়, সময় থাকতে উনি যদি সতর্ক না করেন কে করবে বলো ত? এই বলিয়া তিনি উভয়ের প্রতিই চাহিলেন। মাসী কটাক্ষে চাহিয়া দেখিলেন বন্দনার মুখ ছায়াছন্ন হইয়াছে, অপ্রতিভকণ্ঠে ব্যস্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, এ বলা অত্যন্ত অসঙ্গত মিস্টার রে। আপনার এক শ’ বছর পরমায়ু হোক আমরা সবাই প্রার্থনা করি, আমি শুধু বলতে চেয়েছিলুম—
সাহেব বাধা দিলেন,—না, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। সত্যিই স্বাস্থ্য আমার ভালো না। সময়ে সাবধান না হওয়া, কর্তব্যে অবহেলা করা আমার পক্ষে সত্যিই অন্যায়।
বন্দনা গূঢ় ক্রোধ দমন করিয়া বলিল, আজ বাবার খাওয়া হবে না মাসীমা।
মাসী বলিলেন, থাক এ—সব আলোচনা মিস্টার রে। আপনার খাওয়া না হলে আমি ভারী কষ্ট পাবো।
সাহেবের আহারে রুচি চলিয়া গিয়াছিল, তথাপি জোর করিয়া তিনি এক টুকরা মাংস কাটিয়া মুখে পুরিলেন। অতঃপর খাওয়ার কার্য কিছুক্ষণ ধরিয়া নীরবেই চলিল।
সাহেব প্রশ্ন করিলেন, জামাইয়ের প্র্যাক্টিস কিরকম হচ্চে মিসেস ঘোষাল?
মাসী জবাব দিলেন, এই ত আরম্ভ করেছেন। শুনতে পাই মন্দ না।
আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিলে তিনি মুখের গ্রাসটা গিলিয়া লইয়া কহিলেন, প্র্যাক্টিস যাই হোক মিস্টার রে, আমি এইটেই খুব বড় মনে করিনে। আমি বলি তার চেয়েও ঢের বড় মানুষের চরিত্র। সে নির্মল না হলে কোন মেয়েই কোনদিন যথার্থ সুখী হতে পারে না।
তাতে আর সন্দেহ আছে কি!
মাসী বলিতে লাগিলেন, আমার মুশকিল হয়েছে আমার বাপের বাড়ির শিক্ষা-সংস্কার, তাঁদের দৃষ্টান্ত আমার মনে গাঁথা। তার থেকে একতিল কোথাও কম দেখলে আর সইতে পারিনে। আমার অশোককে দেখলে সেই নৈতিক আবহাওয়ার কথা মনে পড়ে, ছেলেবেলায় যার মধ্যে আমি মানুষ। আমার বাবা, আমার দাদা — এই অশোকও হয়েছে ঠিক তাঁদের মতো। তেমনি সরল, তেমনি উদার, তেমনি চরিত্রবান।
রে-সাহেব সম্পূর্ণ মানিয়া লইলেন, বলিলেন, আমারও ঠিক তাই মনে হয়েছে মিসেস ঘোষাল। ছেলেটি অতি সৎ। ছ-সাত দিন এখানে ছিল, তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। এই বলিয়া তিনি কন্যাকে সাক্ষ্য মানিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বলিস বুড়ী, অশোককে আমাদের কি ভালই লেগেছিল। যেদিন চলে গেল আমার ত সমস্ত দিন মন খারাপ হয়ে রইলো।
বন্দনা স্বীকার করিয়া কহিল, হাঁ বাবা, চমৎকার মানুষ। যেমন বিনয়ী তেমনি ভদ্র।
আমার ত কোন অনুরোধে কখনো না বলেন নি। আমাকে বোম্বায়ে তিনি না পৌঁছে দিলে আমার বিপদ হতো।
মাসী বলিলেন, আর একটা জিনিস বোধ হয় লক্ষ্য করেছো বন্দনা, ওর স্নবরি নেই। যেটি আজকালকার দিনের দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয় যে আমাদের মধ্যে অনেকেরই দেখতে পাওয়া যায়।
বন্দনা সহাস্যে কহিল, তোমার বাড়িতে কোন স্নবের দেখা ত কোনদিন পাইনি মাসীমা।
মাসী হাসিয়া বলিলেন, পেয়েছো বৈ কি মা। তুমি অতি বুদ্ধিমতী, তোমাকে ঠকাবে তারা কি করে?
শুনিয়া রে-সাহেবও হাসিলেন, কথাটি তাঁহার ভারী ভালো লাগিল। বলিলেন, এত বুদ্ধি সচরাচর মেলে না মিসেস ঘোষাল। বাপের মুখে এ কথা গর্বের মতো শুনতে, কিন্তু না বলেও পারিনে।
বন্দনা বলিল, এ প্রসঙ্গ তুমি বন্ধ করো মাসীমা, নইলে বাবাকে সামলানো যাবে না। তুমি এক-মেয়ের দোষগুলোই দেখেছো, কিন্তু দেখোনি যে এক-মেয়ের বাপেদের মতো দাম্ভিক লোকও পৃথিবীতে কম। আমার বাবার ধারণা ওঁর মেয়ের মতো মেয়ে সংসারে আর দ্বিতীয় নেই।
মাসী বলিলেন, সে ধারণার আমিও বড় অংশীদার বন্দনা। শাস্তি পেতে হলে আমারও পাওয়া উচিত।
পিতার মুখে অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তির মৃদু হাসি, কহিলেন, আমি দাম্ভিক কিনা জানিনে, কিন্তু জানি কন্যা-রত্নে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান। এমন মেয়ে কম বাপেই পায়।
বন্দনা বলিল, বাবা, কৈ আজ ত তুমি একটিও সন্দেশ খেলে না? ভালো হয়নি বুঝি?
সাহেব প্লেট হইতে আধখানা সন্দেশ ভাঙ্গিয়া লইয়া মুখে দিলেন, বলিলেন, সমস্ত বুড়ীর নিজের হাতের তৈরি। এবার কলকাতা থেকে ফিরে পর্যন্ত ও সমস্ত খাওয়া বদলে দিয়েছে। ডালনা, সুক্ত, মাছের ঝোল, দই, সন্দেশ আরও কত কি। কার কাছে শুনে এসেছে জানিনে, কিন্তু বাড়িতে মাংস প্রায় আনতেই দেয় না। বলে বাবার ওতে অসুখ করে। দেখুন মিসেস ঘোষাল, এই-সব বাঙলা খাওয়া খেয়ে মনে হয় যেন বুড়ো বয়েসে আছি ভালো। বেশ যেন একটু ক্ষিদে বোধ করি।