সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, জামাই-বাবাজীকে দেখচি নে ত?
সতী কহিল, তিনি সকালেই কি একটা জরুরী কাজে বেরিয়েচেন, ফিরতে বোধ করি দেরি হবে।
বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, মেজদি, তোমার শাশুড়ীকে ত দেখতে পেলুম না? বাড়িতেই আছেন?
সতী কহিল, এখনো আছেন, কিন্তু শীঘ্রই কৈলাস মানস-সরোবরে তীর্থযাত্রা করবেন। সমস্ত সকালটা পূজো-আহ্নিক নিয়েই থাকেন। আর একটু বেলা হলেই তাঁকে দেখতে পাবে।
বন্দনা প্রশ্ন করিল, তিনি খুব বেশী ধর্মকর্ম নিয়েই থাকেন, না?
সতী বলিল, হাঁ।
বিধবা হবার পরে শুনেচি ঘর-সংসার কিছুই দেখেন না, সত্যি?
সত্যি বৈ কি। সব আমাকেই দেখতে শুনতে হয়।
বন্দনা উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, উনি তোমার সৎশাশুড়ী না মেজদি?
সতী হাসিয়া কহিল, চোখে ত দেখিনি বোন, লোকে হয়ত মিথ্যে কথা বলে।
দ্বিজদাস উত্তর দিয়া বলিল, মিথ্যেই বলে। কারণ, সৎশাশুড়ী মানে দাদার সৎমা ত? মিছে কথা। সৎমা বটে, দাদার নয়, আমার। সে যাক, স্নানাদি সেরে নিয়ে সে আলোচনা পরে হবে,—এখন ওপরে চলুন। আচ্ছা, আমি দেখি গে—বৌদি, আর দেরি করো না, এঁদের নিয়ে এস। এই বলিয়া সে আয়োজনের তত্ত্বাবধান করিতে চলিয়া যাইতেছিল, এমনি সময় মাকে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল।
খুব সম্ভব দয়াময়ী খবর পাইয়া আহ্নিকের মাঝখানেই পূজার ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছিলেন। বয়স বেশী নয় বলিয়া তিনি বৈধব্যের পরেও সচরাচর অনাত্মীয় পুরুষদের সম্মুখে বাহির হইতেন না, অন্তরালে থাকিয়াই কথা কহিতেন, কিন্তু আজ একেবারে ঘরের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইলেন। মাথার কাপড় কপালের উপর পর্যন্ত টানিয়া দেওয়া,—কিন্তু মুখের সবখানিই দেখা যাইতেছে।
আমার সেজকাকাবাবু, মা। আর এইটি আমার বোন বন্দনা। এই বলিয়া সতী কাছে আসিয়া হঠাৎ শাশুড়ীকে প্রণাম করিল। এমন অকারণে প্রণাম করা প্রথাও নয়, কেহ করেও না। দয়াময়ী মনে মনে হয়তো একটু আশ্চর্য হইলেন, কিন্তু সে উঠিয়া দাঁড়াইতে সস্নেহে সযত্নে তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলির প্রান্তভাগ চুম্বন করিয়া আশীর্বাদ করিলেন, কিন্তু বন্দনার প্রতি চোখ পড়িতেই তাঁহার চোখের দৃষ্টি রুক্ষ হইয়া উঠিল। দিদির দেখাদেখি সেও কাছে আসিয়া প্রণাম করিল, কিন্তু তিনি স্পর্শ করিলেন না, বরঞ্চ বোধ হয় স্পর্শ বাঁচাইতেই এক-পা পিছাইয়া গিয়া শুধু অস্ফুটে বলিলেন, বেঁচে থাক।
কহিলেন, বেইমশাই, নমস্কার। ছেলেমেয়ের ভাগ্য যে হঠাৎ আপনার পায়ের ধূলো পড়ল।
ভদ্রলোক প্রতি-নমস্কার করিয়া কহিলেন, নানা কারণে সময় পাইনে বেন্ঠাকরুন, কিন্তু না বলে কয়ে এমন হঠাৎ এসে পড়ার দোষ মার্জনা করবেন। এবারে যখন আসব যথাসময়ে একটা খবর দিয়েই আসব।
দয়াময়ী এ-সব কথার উত্তর দিলেন না, শুধু বলিলেন, পূজো-আহ্নিক এখনো সারা হয়নি বেইমশাই, আবার দেখা হবে। বৌমা, এদের ওপরে নিয়ে যাও, খাওয়া-দাওয়ার যেন কষ্ট না হয়। বিপিন এলে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দিয়ো। এই বলিয়া তিনি আর কোন দিকে না চাহিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। বাহ্যতঃ, প্রচলিত সৌজন্যের বিশেষ কিছু যে ত্রুটি হইল তাহা নয়, কিন্তু ভিতরের দিক দিয়া সকলেরই মনে হইল জ্যোৎস্নার মাঝামাঝি একখণ্ড কালো মেঘ নির্মল আকাশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ভাসিয়া গেল।
বিপ্রদাস – ০৫
পাঁচ
বন্দনা স্নানাদি সারিয়া বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, পিতা ইতিপূর্বেই প্রস্তুত হইয়া লইয়াছেন। একখানা জমকালোগোছের আরামকেদারায় বসিয়া চোখে চশমা দিয়া সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করিয়াছেন। পাশের ছোট্ট টেবিলের উপর একরাশ খবরের কাগজ এবং কাছে দাঁড়াইয়া দ্বিজদাস সেইগুলির তারিখ মিলাইয়া গুছাইয়া দিতেছে। ট্রেনের মধ্যে ও কাজের ভিড়ে কয়েকদিনের কাগজ দেখিবার তাঁহার সুযোগ হয় নাই। কন্যাকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া চোখ তুলিয়া কহিলেন, মা, আমরা দুটোর গাড়িতেই কলকাতা যাব স্থির করলাম। দিদির বাড়িতে দিন-কতক যদি তোমার থাকবার ইচ্ছে হয় ত ফেরবার পথে তোমাকে পোঁছে দিয়ে আমি সোজা বোম্বাই চলে যাব। কি বল?
কলকাতায় তোমার ক’দিন দেরি হবে বাবা?
পাঁচ-সাত দিন—দিন-আষ্টেক,—তার বেশী নয়।
কিন্তু তার পরে আমাকে বোম্বায়ে নিয়ে যাবে কে?
সে ব্যবস্থা একটা অনায়াসে হতে পারবে। এই বলিয়া তিনি একটু ভাবিয়া কহিলেন, তা বেশ, ইচ্ছে হয় এই ক’টা দিন তুমি সতীর কাছে থাক, ফেরবার পথে আমিই সঙ্গে করে নিয়ে যাব, কেমন?
বন্দনা ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা মেজদিকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।
দ্বিজদাস কহিল, বৌদি রান্নাঘরে ঢুকেছেন, হয়ত দেরি হবে। হাতের বাণ্ডিলটা দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনাকে কি দেব?
খবরের কাগজ? ও আমি পড়িনে।
কাগজ পড়েন না?
না। ও আমার ধৈর্য থাকে না। সন্ধ্যাবেলা বাবার মুখে গল্প শুনি তাতেই আমার ক্ষিধে মিটে।
আশ্চর্য! আমি ভেবেছিলাম আপনি নিশ্চয়ই খুব বেশী পড়েন।
বন্দনা বলিল, আমার সম্বন্ধে কিছুই না জেনে অমন ভাবেন কেন? ভারী অন্যায়।
দ্বিজু অপ্রতিভ হইয়া উঠিতেছিল, বন্দনা হাসিয়া কহিল, আপনারা কে কতটা দেশোদ্ধার করলেন, এবং ইংরেজ তাতে রেগে গিয়ে কতখানি চোখ রাঙ্গালে তার কিছুতেই আমার কৌতূহল নেই। আছে বাবার। ঐ দেখুন না, একেবারে খবরের তলায় তলিয়ে গেছেন,—বাহ্যজ্ঞান নেই।
সাহেবের কানে বোধ করি শুধু মেয়ের ‘বাবা’ কথাটাই প্রবেশ করিয়াছিল, কিন্তু চোখ তুলিবার সময় পাইলেন না, বলিলেন, একটু সবুর কর—বলচি—ঠিক এই জবাবটাই আমি খুঁজছিলাম।