বন্দনা কহিল, এ প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর ও ভদ্ররুচি-বিগর্হিত। উনি দেখেন নি এই কথাই হচ্ছিলো। তা শুনুন। ওঁকে অনুমতি দিয়েছি সঙ্গে যাবার, তাতে এত খুশী হয়েচেন যে তার পরে আমাকে সঙ্গে করে বোম্বাই পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সম্মত হয়েচেন।
বিপ্রদাস মুখ অতিশয় গম্ভীর করিয়া কহিল, বলো কি? এতখানি ত্যাগ স্বীকার আমাদের সমাজে মেলে না, এ শুধু তোমাদের মধ্যেই পাওয়া যায়। শুনে বিস্ময় লাগচে।
বন্দনা বলিল, লাগবার কথাই যে। জপ-তপও আছে, ষোল-আনা হিংসেও আছে। এই বলিয়া সে চোখের দৃষ্টিতে এক ঝলক বিদ্যুৎ ছড়াইয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল, বিপ্রদাস তাহাকে ডাকিয়া কহিল, এ যেন কথামালার সেই কুকুরের ভূষি আগলানোর গল্প। খাবেও না, আর ষাঁড়ের দল এসে যে মনের সাধে চিবোবে তাও দেবে না। মানুষ বাঁচে কি করে বলো ত?
বন্দনা দ্বার-প্রান্তে থমকিয়া দাঁড়াইয়া কৃত্রিম রোষে ভ্রূ-কুঞ্চিত করিল, বলিল, ঠিক আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ, কিচ্ছু তফাত নেই। লোকগুলো কেবল মিথ্যে ভয় করে মরে।
তুমি গিয়ে এবার তাদের ভয় ভেঙ্গে দিয়ে এসো।
তাই তো যাচ্চি এবং ভূষির সঙ্গে একজনের উপমা দেবার দুর্বুদ্ধিরও শোধ নিয়ে আসবো—এই বলিয়া বন্দনা দীপ্ত কটাক্ষে পুনরায় তড়িৎ-বৃষ্টি করিয়া দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।
বিপ্রদাস কহিল, মিস্টার—
অশোক সবিনয়ে বাধা দিল,—না না, চলবে না। ওটাকে বাদ দিতে বাধবে না বলেই ধুতি-চাদর এবং চটি-জুতো পরে এসেচি বিপ্রদাসবাবু। উনিও ভরসা দিয়েছিলেন যে—
বিপ্রদাস মনে মনে খুশী হইয়া বলিল, ভালোই হ’লো অশোকবাবু, সম্বোধনটা সহজ দাঁড়ালো। পাড়াগাঁয়ে মানুষ, মনেও থাকে না, অভ্যাসও নেই, এবার স্বচ্ছন্দে আলাপ জমাতে পারবো। শুনলুম আমাদের পল্লীগ্রামের বাড়িতে যেতে চেয়েছেন, সত্যিই যদি যান ত কৃতার্থ হবো। আমাদের সংসারের কর্ত্রী আমার মা, তাঁর পক্ষ থেকে আপনাকে আমি সসম্মানে আমন্ত্রণ করচি।
বিপ্রদাসের বিনয়-বচনে অশোক পুলকিতচিত্তে বলিল, নিশ্চয় যাবো—নিশ্চয় যাবো। কত দরিদ্র অনাথ আতুর আসবে নিমন্ত্রণ রাখতে, কত অধ্যাপক পণ্ডিত উপস্থিত হবেন বিদায় গ্রহণ করতে—আনন্দোৎসবে কত খাওয়া–দাওয়া, কত আসা-যাওয়া, কত বিচিত্র আয়োজন—
বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, সমস্ত বাড়ানো কথা অশোকবাবু, বন্দনা শুধু রহস্য করেছে।
রহস্য করে তার লাভ কি বিপ্রদাসবাবু?
একটা লাভ আমাদের অপ্রতিভ করা। বলরামপুরের মুখুয্যেদের ওপর সে মনে মনে চটা। দ্বিতীয় লাভ আপনাকে সে কোন ছলে বোম্বায়ে টেনে নিয়ে যেতে চায়।
অশোক বলিল, প্রয়োজন হলে বোম্বাই পর্যন্ত আমাকে সঙ্গে যেতে হবে এ কথা আছে, কিন্তু মুখুয্যেদের পরে সে চটা, আপনাদের সে লজ্জিত করতে চায় এমন হতেই পারে না। কালও বলরামপুরে যাবার স্থির ছিল না, কিন্তু আপনাদের কথা নিয়ে ওর মাসীর সঙ্গে হয়ে গেল ঝগড়া। মাসী বললেন, বিপ্রদাসের মা সর্বসাধারণের হিতার্থে যদি জলাশয় খনন করিয়ে থাকেন ত তাঁর প্রশংসা করি, কিন্তু ঘটা করে প্রতিষ্ঠা করার কোন অর্থ নেই,—ওটা কুসংস্কার। কুসংস্কারে যোগ দেওয়া আমি অন্যায় মনে করি। বন্দনা বললেন,—ওঁরা বড়লোক, বড়লোকের কাজেকর্মে ঘটা ত হয়েই থাকে মাসীমা। তাতে আশ্চর্যের কি আছে? আমার পিসীমা বললেন, বড়লোকের অপব্যয়ে আশ্চর্যের কিছু নেই মানি, কিন্তু ও-ত কেবল ও-ই নয়, ও-টা কুসংস্কার। তোমার যাওয়াতেই আমার আপত্তি। বন্দনা বললেন, আমি কিন্তু কুসংস্কার মনে করিনে মাসীমা। বরঞ্চ, এই মনে করি যে, যা জানিনে, জানার কখনো চেষ্টা করিনি, তাকে সরাসরি বিচার করতে যাওয়াই কুসংস্কার। ওঁর জবাব শুনে পিসীমা রাগে জ্বলে গেলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাবার অনুমতি নিয়েছো?
বন্দনা উত্তর দিলেন, বাবা বারণ করবেন না আমি জানি। দিদির স্বামী অসুস্থ, তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার ভার পড়েছে আমার ওপর।
ভার দিলে কে শুনি? তিনি নিজেই বোধ হয়? প্রশ্ন শুনে বন্দনা যেন অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। আমার মনে হলো তাঁর মাথায় দ্রুত রক্ত চড়ে যাচ্ছে, এবার হঠাৎ কি একটা বলে ফেলবেন, কিন্তু, সে-সব কিছুই করলেন না, শুধু আস্তে আস্তে বললেন, যে যা খুশি জিজ্ঞেসা করলেই যে আমাকে জবাব দিতে হবে ছেলেবেলা থেকে এ শিক্ষা আমার হয়নি মাসীমা। পরশু সকালে মুখুয্যেমশাইকে নিয়ে আমি বলরামপুরে যাবো এর বেশি তোমাকে বলতে পারবো না।
পিসীমা রাগ করে উঠে গেলেন। আমি বললুম, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন? আমার ভারী ইচ্ছে করে ঐ-সব আচার-অনুষ্ঠান চোখে দেখি। বন্দনা বললেন, কিন্তু সে-সব যে কুসংস্কার অশোকবাবু। চোখে দেখলেও যে আপনাদের জাত যায়। বললুম, যদি আপনার না যায় ত আমারও যাবে না। আর যদি যায় ত দুজনের একসঙ্গেই জাত যাক, আমার কোন ক্ষতি নেই।
বন্দনা বললেন, আপনি ত বিশ্বাস করেন না, সে-সব চোখে দেখলে যে মনে মনে হাসবেন।
বললুম, আপনিই কি বিশ্বাস করেন নাকি? তিনি বললেন, না করিনে, কিন্তু মুখুয্যেমশাই করেন। আমি কেবল আশা করি তাঁর বিশ্বাসই যেন একদিন আমারও সত্যি বিশ্বাস হয়ে ওঠে। বিপ্রদাসবাবু, আপনাকে বন্দনা মনে মনে পূজো করে, এত ভক্তি সে জগতে কাউকে করে না।
খবরটা অজানা নয়, নূতনও নয়, তথাপি অপরের মুখে শুনিয়া তাহার নিজের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হইয়া গেল।
ক্ষণেক পরে প্রশ্ন করিল, আপনাদের যে বিবাহের প্রস্তাব হয়েছিল সে কি স্থির হয়ে গেছে? বন্দনা সম্মতি দিয়েছেন?