একটা মিনতি আছে। দাদাকে সঙ্গে নিয়ে আপনাকে আমাদের দেশের বাড়িতে একবার যেতে হবে।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে? এর হেতু?
দ্বিজদাস কহিল, বলবো বলেই দাঁড়িয়ে আছি। একদিন বিনা আহ্বানেই আমাদের বাড়িতে পায়ের ধূলো দিয়েছিলেন, আজ আবার সেই দয়া আপনাকে করতে হবে।
বন্দনা একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করিল, তারপরে বলিল, কিন্তু আমাকে যাবার নিমন্ত্রণ করচে কে? মা, দাদা, না আপনি নিজে?
আমি নিজেই করচি।
কিন্তু আপনি ত ও-বাড়িতে তৃতীয় পক্ষ, ডাকবার আপনার অধিকার কি?
দ্বিজদাস বলিল, আর কোন অধিকার না থাক আমার বাঁচবার অধিকার আছে। সেই অধিকারে এই আবেদন উপস্থিত করলুম। বলুন মঞ্জুর করলেন? একান্ত প্রয়োজন না হলে কোন প্রার্থনাই আমি কারো কাছে করিনে।
বন্দনা বহুক্ষণ পর্যন্ত অন্যদিকে চাহিয়া রহিল, তার পরে বলিল, আচ্ছা, তাই যাবো, কিন্তু আমার মান-অপমানের ভার রইলো আপনার উপর।
দ্বিজদাস সকৃতজ্ঞ-কণ্ঠে কহিল, আমার সাধ্য সামান্য, তবু নিলুম সেই ভার।
বন্দনা বলিল, বিপদের সময়ে এ কথা ভুলবেন না যেন।
না, ভুলবো না।
বিপ্রদাস – ২১
একুশ
অনেকদিনের পরে বিপ্রদাস নীচের আফিসঘরে আসিয়া বসিয়াছে। সম্মুখে টেবিলের পরে কাগজপত্রের স্তূপ—কতদিনের কত কাজ বাকী। দেহ ক্লান্ত, কিন্তু দ্বিজুর ভরসায় ফেলিয়া রাখাও আর চলে না। একটা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা টানিয়া লইয়া সে পাতা উলটাইতেছিল, বাহিরে মোটরের বাঁশী কানে গেল এবং অনতিবিলম্বে পূবের খোলা দরজা দিয়া বন্দনা প্রবেশ করিল। আজ একা নয়, সঙ্গে একটি অপরিচিত যুবক, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে ফুলকাটা কটকি চটি এবং কাঁধ হইতে তির্যক ভঙ্গিতে জড়ানো মোটা সাদা চাদর। বয়স ত্রিশের নীচে, দেহের গঠন আর একটু দীর্ঘচ্ছন্দের হইলে অনায়াসে সুপুরুষ বলা চলিত। বিপ্রদাস অভ্যর্থনা করিতে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
বন্দনা কহিল, মুখুয্যেমশাই, ইনিই মিস্টার চাউড্রি—বার-অ্যাট-ল। কিন্তু এখানে অশোকবাবু বলে ডাকলেও অফেন্স নিতে পারবেন না এই শর্তে আলাপ করিতে দিতে রাজী হয়ে সঙ্গে এনেচি। আলাপ হবে, কিন্তু তার আগে আপন কর্তব্যটা সেরে নিই—এই বলিয়া সে কাছে আসিয়া হেঁট হইয়া নমস্কার করিয়া বলিল, পায়ের ধূলোটা কিন্তু এঁর সুমুখে নিতে পারলুম না পাছে মনে করে বসেন ওঁদের সমাজের আমি কলঙ্ক। কিন্তু তাই বলে যেন অভিমানভরে আপনিও ভেবে নেবেন না নতুন কায়দাটা আমার মাসীর কাছে শেখা। তাঁর পরে আপনার প্রসন্নতার বহরটা আমার পরিমাপ করা কি না!
বিপ্রদাস কহিল, তোমার মাসীমার কাছে এইভাবেই আমার গুণগান করো নাকি? নবাগত যুবকটির প্রতি ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, বন্দনার মুখে আপনার কথা এত বেশি শুনেচি যে অসুস্থ না থাকলে আমি নিজেই যেতুম আলাপ করতে। দেখেই মনে হলো চেহারাটা পর্যন্ত চেনা, যেন কতবার দেখেচি। ভালোই হলো অযথা বিলম্ব না করে উনি নিজেই সঙ্গে করে আনলেন।
ভদ্রলোক প্রত্যুত্তরে কি একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু তাহার পূর্বেই বন্দনা শাসনের ভঙ্গীতে তর্জনী তুলিয়া কহিল, মুখুয্যেমশাই, অত্যুক্তি অতিশয়োক্তিকে ছাড়িয়ে প্রায় মিথ্যার কোঠায় এলো, এবার থামুন নইলে হাঙ্গামা করবো।
ইহার অর্থ?
ইহার অর্থ এই হয় যে আমাদের অতি-সাধারণদের মত সত্যি-মিথ্যে যা খুশি বানিয়ে বলা আপনারও চলে। আপনি মোটেই অসাধারণ ব্যক্তি নয়,—ঠিক আমাদের মতোই সাধারণ মনুষ্য।
বিপ্রদাস কহিল, না। সকলকে জিজ্ঞেসা করো, তারা একবাক্যে সাক্ষ্য দেবে তোমার অনুমান অশ্রদ্ধেয়, অগ্রাহ্য।
বন্দনা বলিল, এবার তাদের কাছেই আপনাকে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঐ সিংহচর্মটি দু’হাতে ছিঁড়ে ফেলে দেবো, তখন আসল মূর্তিটি তারা দেখতে পাবে,—তাদের ভয় ভাঙবে। আমাকে আশীর্বাদ করে বলবে তুমি রাজরানী হও।
বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, আশীর্বাদে আপত্তি নেই, এমন কি নিজে করতেও প্রস্তুত, কিন্তু আশীর্বাদ ত তোমরা চাও না, বলো কুসংস্কার, বলো ও শুধু কথার কথা।
বন্দনা পুনরায় আঙুল তুলিয়া বলিল, ফের খোঁচা দেবার চেষ্টা? কে বলেছে গুরুজনদের আশীর্বাদ আমরা চাইনে,—কে বলেচে, কুসংস্কার? এবার কিন্তু সত্যই রাগ হচ্চে মুখুয্যেমশাই।
বিপ্রদাস গম্ভীর হইয়া বলিল, সত্যই রাগ হচ্চে নাকি? তবে থাক এ-সব গোলমেলে কথা। কিন্তু হঠাৎ সকালবেলাতেই আবির্ভাব কেন? কোন কাজ আছে নাকি?
বন্দনা কহিল, অনেক। প্রথম আপনার কৈফিয়ত নেওয়া। কেন আমার বিনা হুকুমে নীচে নেমে কাজ শুরু করেছেন?
করিনি, করবার সঙ্কল্প করেছিলুম মাত্র। এই রইলো—বলিয়া সেই মোটা খাতাটা বিপ্রদাস দূরে ঠেলিয়া দিল।
বন্দনা প্রসন্নমুখে কহিল, কৈফিয়ত satisfactory; অবাধ্যতা মার্জনা করা গেল। ভবিষ্যতে এমনি অনুগত থাকলেই আমার কাজ চলে যাবে। এবার শুনুন মন দিয়ে। ততক্ষণ এঁর সঙ্গে বসে গল্প করুন—মুখুয্যেদের ঐশ্বর্যের বিবরণ, প্রজা-শাসনের বহু রোমাঞ্চকর কাহিনী—যা খুশি। আমি ওপরে যাচ্ছি অনুদিকে নিয়ে সমস্ত গুছিয়ে নিতে। কাল সকালের ট্রেনে আমরা বলরামপুর যাত্রা করবো, দিনে দিনে যাবো—ঠাণ্ডা লাগার ভয় থাকবে না। মিস্টার চাউড্রির ইচ্ছে সঙ্গে যান,—বড়ঘরের বড়রকমের যাগ-যজ্ঞ-ক্রিয়া-কলাপ দীয়তাং ভুজ্যতাং ঘটা-পটা কখনো চোখে দেখেন নি,—আর কোথা থেকেই বা দেখবেন—
বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করিল, তুমি নিজে নিশ্চয়ই অনেক দেখেচো—