বিপ্রদাস তেমনই হাসিয়া কহিল, টোলের ওপর তোর রাগ কিসের? লোকের মুখে মুখে এদের শুধু নিন্দেই শুনলি, নিজে কখনও চোখে দেখলি নে। ওদের দলভুক্ত বলে হয়ত আমি পর্যন্ত তোর আমলে ভাত পাবো না।
দ্বিজদাস কাছে আসিয়া আর একবার পায়ের ধূলা লইল, কহিল, ঐ কথাটা বলবেন না। আপনি দু দলেরই বাইরে, অথচ তৃতীয় স্থানটা যে কি তাও আমি জানিনে। শুধু এইটুকু জেনে রেখেচি আমার দাদা আমাদের বিচারের বাইরে।
বিপ্রদাস কথাটাকে চাপা দিল। জিজ্ঞাসা করিল, আমার অসুখের কথা মা শোনেন নি ত?
না। সে বরঞ্চ ছিল ভালো, পুকুর-প্রতিষ্ঠার হাঙ্গামা বন্ধ হতো।
আত্মীয়দের আনবার ব্যবস্থা হয়েছে?
হচ্চে। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান—সকলকেই। সকন্যা অক্ষয়বাবুর আমন্ত্রণ-লিপি গেছে, মায়ের বিশ্বাস বৃহৎ ব্যাপারে মৈত্রেয়ীর অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যাবে। আমার ওপর ভার পড়েছে তাঁদের নিয়ে যাবার।
মা আর কাউকে নিয়ে যাবার কথা বলে দেননি?
হাঁ, অনুদিকেও নিয়ে যেতে হবে। কলেজের ছেলেরা যদি কেউ যেতে চায় তারাও!
তোর বৌদিদির কোন ফরমাস নেই?
না।
নীচে আবার মোটরের শব্দ পাওয়া গেল। হর্নের চেনা আওয়াজ কানে আসিতেই বন্দনা জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া বলিল, মাসীমার গাড়ি। আমি দেখি গে মুখুয্যেমশাই। আপনি সন্ধ্যে-আহ্নিক সেরে নিন—দেরি হয়ে যাচ্চে। বলিয়া বাহির হইয়া গেল।
আমিও যাই মুখ-হাত ধুইগে। ঘণ্টা-খানেক পরে আসবো, বলিয়া দ্বিজদাসও চলিয়া গেল। বিপ্রদাসের পূজা-আহ্নিক সমাপ্ত হইল, আজ খাবার ফলমূল দিয়া গেল অন্নদা। মাসীর বাড়ি হইতে যে মেয়েটি নিতে আসিয়াছে বন্দনা ব্যস্ত আছে তাহাকে লইয়া। এ খবর সে-ই দিল।
দ্বিজদাস যথাসময়ে ফিরিয়া আসিল। হাতে তাহার বিরাট ফর্দ, কলিকাতার অর্ধেক জিনিস কিনিয়া গাড়ি বোঝাই করিয়া চালান দিতে হইবে। দুই ভাইয়ে এই লইয়া যখন ভয়ানক ব্যস্ত তখন দরজার বাহির হইতে প্রার্থনা আসিল, মুখুয্যেমশাই, আসতে পারি কি? পায়ে কিন্তু আমার জুতো রয়েছে।
জুতো? তা হোক, এসো।
বন্দনা ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। যে-বেশে বলরামপুরে তাহাকে প্রথম দেখা গিয়েছিল এ সেই বেশ। বিপ্রদাস অত্যন্ত বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, কোথাও যাচ্চো নাকি বন্দনা?
হাঁ, মাসীমার বাড়িতে।
কখন ফিরবে?
ফেরবার কথা ত জানিনে মুখুয্যেমশাই। এই বলিয়া হেঁট হইয়া সে বিপ্রদাসকে প্রণাম করিল, কিন্তু অন্যদিনের মতো পায়ে হাত দিয়া স্পর্শ করিল না। মুখ তুলিল না, শুধু কপালে হাত ঠেকাইয়া দ্বিজদাসকেও নমস্কার করিল, তাহার পরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
বিপ্রদাস – ২০
কুড়ি
দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিল, বন্দনা হঠাৎ চলে গেলেন কেন? আমার এসে পড়াটাই কি কারণ নাকি?
বিপ্রদাস বলিল, না। ওঁর বাবা টেলিগ্রাম করেছেন মাসীর বাড়িতে গিয়ে থাকতে যতদিন না বোম্বায়ে ফিরে যাওয়া ঘটে।
কিন্তু হঠাৎ মাসী বেরুলো কোথা থেকে? বন্দনা আমার সঙ্গে ত প্রায় কথাই কইলেন না, সর্বক্ষণ আড়ালে আড়ালে রইলেন, তার পর সকাল না হতে হতেই দেখচি সরে পড়লেন। একটা নমস্কার করে গেলেন সত্যি কিন্তু সেও মুখ ফিরিয়ে। আমার বিরুদ্ধে হলো কি তাঁর?
প্রশ্নের জবাবটা বিপ্রদাস এড়াইয়া গেল এবং মাসীর ব্যাপারটা সংক্ষেপে জানাইয়া কহিল, আমার অসুখে ভয় পেয়ে এই মাসীর বাড়ি থেকেই অনুদি ওকে ডেকে এনেছিলেন আমার শুশ্রূষা করতে। যথেষ্ট করেচে। ওর কাছে তোদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
দ্বিজদাস কহিল, উচিত নয় বলিনে, কিন্তু আপনাকে সেবা করতে পাওয়াটাও ত একটা ভাগ্য। সে মূল্যটা যদি উনিও অনুভব করতে পেরে থাকেন ত কৃতজ্ঞতা ওঁর কাছেও আমাদের পাওনা আছে।
বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, তুই ভারী নরাধম।
দ্বিজদাস বলিল, নরাধম কিন্তু নির্বোধ নই। আমার কথা যাক। কিন্তু এই সেবা করার কথাটা মায়ের কানে গেলে উনি চিরকাল আমদের মাকেই কিনে রাখবেন। সেই কি সোজা সম্পদ?
শুনিয়া বিপ্রদাস হাসিল, কহিল, মাকে এতকাল পরে তুই চিনতে পেরেছিস বল?
দ্বিজদাস বলিল, যদি পেরেও থাকি সে শুধু আপনিই জানুন। আমি মায়ের কুপুত্র, আমি কুলাঙ্গার, তাঁর কাছে এই পরিচয়ই থাক। একে আর নড়িয়ে কাজ নেই দাদা।
কিন্তু কেন? মা তোকে বিশ্বাস করতে পারেন, তোকে ভাল বলে ভাবতে পারেন, এ কি তুই সত্যিই চাসনে? এ অভিমানে লাভ কি’বল তো?
লাভ কি জানিনে, কিন্তু লোভ বিশেষ নেই। আমি আপনার পেয়েছি স্নেহ, পেয়েছি বৌদিদির ভালবাসা, এই আমার সাত রাজার ধন, সাতজন্ম দু’হাতে বিলিয়েও শেষ করতে পারবো না, কিন্তু বলিয়া ফেলিয়াই তাহার চোখ-মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। হৃদয়ের এই-সকল আবেগ-উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করিতে সে চিরদিন পরাঙ্মুখ,—চিরদিন নিস্পৃহতার আবরণে ঢাকা দিয়া বেড়ানোই তাহার প্রকৃতি,—মুহূর্তে নিজেকে সামলাইয়া ফেলিয়া বলিল, কিন্তু এ-সব আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যেটা প্রয়োজন সে হচ্চে এই যে, আমার চোখে বন্দনার চলে যাওয়ার ভাবটা দেখালো যেন রাগের মতো। এর মানেটা বলে দিন।
মানেটা বোধ হয় এই যে, তুই যখন এসে পড়েছিস তখন ওর আর দরকার নেই। এখন থেকে সেবা-শুশ্রূষার ভার তোর উপর। এই বলিয়া বিপ্রদাস হাসিতে লাগিল।
দ্বিজদাস বলিল, আপনি ঠাট্টা করচেন বটে, কিন্তু আমি বলচি, এই-সব ইংরেজিনবিশ মেয়েগুলো এই দম্ভতেই একদিন মরবে। আপনাকে রোগে সেবা করবার দিন যেন-না কখনও আসে, কিন্তু এলে প্রমাণ হতে দেরি হবে না যে দাদার সেবায় দ্বিজুকে হারানো দশটা বন্দনার সাধ্যে কুলোবে না, এ কথা তাকে জানিয়ে দেবেন।