বিপ্রদাস মাথা নাড়িয়া স্বীকার করিল, বলিল, হয়তো এ কথা তোমার সত্যি বন্দনা, এ আমার সংস্কার,—সুদৃঢ় সংস্কার, কিন্তু মানুষের ধর্ম যখন এই সংস্কারের রূপ ধরে বন্দনা, তখনি সে হয় যথার্থ, তখনি হয় সে সহজ। জীবনের কর্তব্যে আর তখন ঠোকাঠুকি বাধে না, তাকে মানতে গিয়ে নিজের সঙ্গে লড়াই করে মরতে হয় না। তখন বুদ্ধি হয়ে আসে শান্ত, অবাধ জলস্রোতের মতো সে সহজে বয়ে যায়। বুঝি একেই বলেছিলুম সেদিন এ হলো বিপ্রদাসের অত্যাজ্য ধর্ম—এর আর পরিবর্তন নেই।
কোনদিনই কি এর পরিবর্তন নেই মুখুয্যেমশাই?
তাইত আজও জানি বন্দনা। আজও ভাবতে পারিনে এ-জীবনে এর পরিবর্তন আছে।
এতক্ষণে বন্দনার দুই চোখ বাষ্পাকুল হইয়া উঠিল, বিপ্রদাস সযত্নে তাহার হাতখানি টানিয়া লইয়া বলিল, কিন্তু পরিবর্তনেরই বা দরকার কিসের? ভালো তোমাকে বেসেচি,—রইলো তোমার সে ভালোবাসা আমার মনের মধ্যে,—এখন থেকে সে দেবে আমাকে দুঃখে সান্ত্বনা, দুর্বলতায় বল, ভার যখন আর একাকী বইতে পারবো না তখন দেবো তোমাকে ডাক। সে-ও রইলো আজ থেকে তোমার জন্যে তোলা। আসবে ত তখন?
বন্দনা বাঁ হাত দিয়া চোখ মুছিয়া বলিল, আসবো যদি আসার শক্তি থাকে,—পথ যদি থাকে তখনও খোলা, নইলে পারবো না ত আসতে মুখুয্যেমশাই।
কথাটা শুনিয়া বিপ্রদাস যেন চমকিয়া গেল, বলিল, বটেই ত! বটেই ত! আসার পথ থাকে যদি খোলা,—চিরদিনের তরে যদি বন্ধ হয়ে সে না যায়। তখন এসো কিন্তু। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থেকো না।
বন্দনা চোখের জল আবার মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, আমার একটি ভিক্ষে রইলো মুখুয্যেমশাই, আমার কথা যেন কাউকে বলবেন না।
না, বলবো না। বলার লোক যে আমার নেই সে ত তুমি নিজেই জানতে পেরেচো।
হাঁ পেরেচি।
দুইজনে কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল।
বিপ্রদাস কহিল, এই বিপুল সংসারে আমি যে এতখানি একা এ কথা তুমি কি করে বুঝেছিলে বন্দনা?
বন্দনা বলিল, কি জানি কি করে বুঝেছিলুম। আপনাদের বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এলুম, আপনি এলেন সঙ্গে। গাড়িতে সেই মাতাল সাহেবগুলোর কথা মনে পড়ে? ব্যাপারটা বিশেষ কিছু নয়—তবু মনে হলো যাদের আমরা চারপাশে দেখি তাদের দলের আপনি নয়,—একাকী কোন ভার কাঁধে নিতেই আপনার বাধে না। এই কথাই বলেছিলেন সেদিন দ্বিজুবাবু,—মিলিয়ে দেখলুম কারও কাছে কিছুই আপনি প্রত্যাশা করেন না। রাত্রে বিছানায় শুয়ে কেবলি আপনাকে মনে পড়ে—কিছুতে ঘুমোতে পারলুম না। শেষরাত্রে উঠে দেখি নীচে পূজোর ঘরে আলো জ্বলছে, আপনি বসেছেন ধ্যানে। একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে ভোর হয়ে এলো, পাছে চাকররা কেউ দেখতে পায়, ভয়ে ভয়ে পালিয়ে এলুম আমার ঘরে। আপনার সে মূর্তি আর ভুলতে পারলুম না মুখুয্যেমশাই, আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই।
বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, দেখেছিলে নাকি আমাকে পূজো করতে?
বন্দনা বলিল, পূজো করতে ত আপনার মাকেও দেখেচি, কিন্তু সে ও নয়। সে আলাদা। আপনি কিসের ধ্যান করেন মুখুয্যেমশাই?
বিপ্রদাস পুনরায় হাসিয়া বলিল, সে জেনে তোমার কি হবে? তুমি ত তা করবে না!
না করবো না। তবু জানতে ইচ্ছে করে।
বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। বন্দনা কহিতে লাগিল, আমার সেইদিনই প্রথম মনে হয় সকলের মধ্যে থেকেও আপনি আলাদা, আপনি একা। যেখানে উঠলে আপনার সঙ্গী হওয়া যায় সে উঁচুতে ওরা কেউ উঠতে পারে না। আর একটা কথা জিজ্ঞেসা করবো মুখুয্যেমশাই? বলবেন?
কি কথা বন্দনা?
মেয়েদের ভালোবাসায় বোধ হয় আর আপনার প্রয়োজন নেই—না?
এ প্রশ্নর মানে?
মানে জানিনে, এমনি জিজ্ঞেসা করচি। এ বোধ হয় আর আপনি কামনা করেন না,—আপনার কাছে একেবারে তুচ্ছ হয়ে গেছে।—সত্যি কিনা বলুন।
বিপ্রদাস উত্তর দিল না, শুধু হাসিমুখে চাহিয়া রহিল।
নীচের প্রাঙ্গণে সহসা গাড়ির শব্দ শোনা গেল, আর পাওয়া গেল দ্বিজদাসের কণ্ঠস্বর। এবং, পরক্ষণেই দ্বারের কাছে আসিয়া অন্নদা ডাকিয়া বলিল, দ্বিজু এলো বিপিন।
একলা নাকি? না, আর কেউ সঙ্গে এলো?
না, একাই ত দেখচি। আর কেউ নেই।
শুনিয়া বন্দনা ব্যস্ত হইয়া উঠিল, বলিল, যাই মুখুয্যেমশাই, দেখি গে তাঁর খাবার যোগাড় ঠিক আছে কিনা। বলিয়া বাহির হইয়া গেল।
সকালে দ্বিজু আসিয়া যখন বিপ্রদাসের পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল তখন ঘরের একধারে বসিয়া বন্দনা পূজার সজ্জা প্রস্তুত করিতেছিল, দ্বিজদাস বলিল, এই পঞ্চমীতে মায়ের পুকুর – প্রতিষ্ঠা। বৃহৎ ব্যাপার দাদা!
মায়ের কাজে ত বৃহৎ ব্যাপারই হয় দ্বিজু, এতে ভাবনার কি আছে? বলিয়া বিপ্রদাস হাসিল।
দ্বিজদাস কহিল, তা হয়। এবার সঙ্গে মিলেছে বাসুর ভালো হওয়ার মানতপূজো—সেও একটা অশ্বমেধ যজ্ঞ। অধ্যাপক বিদায়ের ফর্দ তৈরি হচ্ছে,—কুটুম্ব-সজ্জন অতিথি-অভ্যাগতের যে সংক্ষিপ্ত তালিকা বৌদিদির মুখে মুখে পেলুম তাতে আশঙ্কা হয় এবার আপনার অর্থে ওরা কিঞ্চিৎ গভীর খাবোল মারবে। সময় থাকতে সতর্ক হোন।
বন্দনা মুখ তুলিল না, কিন্তু সামলাইতে না পারিয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল। বিপ্রদাস বিষয়ী লোক, বিপ্রদাস কৃপণ, এ দুর্নাম একা মা ছাড়া প্রচার করিবার সুযোগ পাইলে কেহ ছাড়ে না। বিপ্রদাস নিজেও এ হাসিতে যোগ দিয়া বলিল, এবার কিন্তু তোর পালা। এবার খরচ হবে তোর।
আমার? কোন আপত্তি নেই যদি থাকে। কিন্তু তাতে ব্যবস্থার কিছু অদল-বদল করতে হবে। বিদায় যারা পাবে তারা টোলের পণ্ডিত-সমাজ নয়, বরঞ্চ টোলের দোর বন্ধ করে যাদের বাইরে ঠেলে রাখা হয়েচে,—তারা।