বিপ্রদাস বলিল, সচরাচর তাই ত দিয়ে থাকি। প্রশ্নটা কি?
বন্দনা বলিল, মেজদিদিকে আপনি কি সত্যিই ভালবাসেন? ছেলেবেলায় আপনাদের বিয়ে হয়েছে—সে কতদিনের কথা—কখনো কি এর অন্যথা ঘটেনি?
বিপ্রদাস অবাক হইয়া গেল। এমন কথা যে কাহারও মনে আসিতে পারে সে কল্পনাও করে নাই। কিন্তু আপনাকে সামলাইয়া লইয়া সহাস্যে কহিল, তোমার মেজদিদিকেই বরঞ্চ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেসা করো।
বন্দনা বলিল, তিনি জানবেন কি করে? আপনার আসল মনের কথা ত শুনেচি কেউ জানতে পারে না। না বলতে চান বলবেন না, আমি এরকম করে বুঝে নেবো, কিন্তু বললে সত্যি কথাই আপনাকে বলতে হবে।
সত্যি কথাই বলবো, কিন্তু আমাকে কি তোমার সন্দেহ হয়?
হয়। আপনি অনেক বড় মানুষ, কিন্তু তবুও মানুষ। মনে হয় কোথায় যেন আপনি ভারী একলা, সেখানে আপনার কেউ সঙ্গী নেই। এ কথা কি সত্যি নয়?
বিপ্রদাস এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিল না, বলিল, স্ত্রীকে ভালবাসা যে আমার ধর্ম বন্দনা।
বন্দনা বলিল, ধর্ম যতদূর প্রসারিত ততদূর আপনি খাঁটি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কি সংসারে কিছু নেই?
দেখতে ত পাইনে বন্দনা।
বন্দনা বলিল, আমি দেখতে পাই মুখুয্যেমশাই। বলবো সে কথা?
বিপ্রদাসের মুখ সহসা যেন পাণ্ডুর হইয়া উঠিল,—বলিষ্ঠ গৌরবর্ণ মুখে যেন রক্তের লেশ নাই, দুই হাত সম্মুখে বাড়াইয়া বলিল, না, একটি কথাও নয় বন্দনা। আজ তোমার ঘরে যাও,—কাল হোক, পরশু হোক,—আবার যখন প্রকৃতিস্থ হয়ে আলোচনার বুদ্ধি ফিরে পাবে তখন এর জবাব দেবো। কিংবা হয়তো আপনিই তখন বুঝবে, ঐ যারা তোমার মাসীর বাড়িতে বুদ্ধিকে তোমার আচ্ছন্ন করেছে তারাই সব নয়। ধর্ম যাদের কাছে অত্যাজ্য তারাও আছে, জগতে তারাও বাস করে। না না, আর তর্ক নয়,—তুমি যাও।
বন্দনা বুঝিল, এ আদেশ অবহেলার নয়। এই হয়ত সেই বস্তু যাহাকে বাড়িসুদ্ধ সকলে ভয় করে। বন্দনা নিঃশব্দে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
বিপ্রদাস – ১৯
উনিশ
পরদিন বিকালের দিকে বন্দনা আসিয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই, আবার চললুম মাসীমার বাড়িতে। এবার আর ঘণ্টা-কয়েকের জন্যে নয়, এবার যতদিন না মাসী আমাকে বোম্বায়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে ততদিন।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ আরজেন্ট টেলিগ্রামে এসেছে বাবার হুকুম। কালই সকালবেলা মাসী গাড়ি পাঠাবেন আমাকে নিতে।
বিপ্রদাস কহিল, অর্থাৎ বোঝা গেল তোমার মাসীর প্রতিশোধ নেবার অধ্যবসায় এবং বুদ্ধি আছে। এ বোধ হয় তাঁরই প্রিপেড টেলিগ্রামের জবাব। কৈ দেখি কাগজটা?
না, সে আপনাকে দেখাতে পারবো না।
শুনিয়া বিপ্রদাস ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপর ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ভগবান যে কারো দর্প রাখেন না এ তারই নমুনা। এতদিন ধারণা ছিল আমাকে জড়ানো যায় না, কিন্তু দেখচি যায়। অন্ততঃ, তেমন লোকও আছে। তোমার মাসীর মাথায় এ ফন্দিও খেলেছে। দাও না পড়ে দেখি অভিযোগটা কতখানি গুরুতর, বলিয়া সে হাত বাড়াইল।
এবার বন্দনা কাগজখানা তাঁহার হাতে দিল। রায়সাহেবের সুদীর্ঘ টেলিগ্রাম,—সমস্তটা আগাগোড়া পড়িয়া সেটা ফিরাইয়া দিয়া বিপ্রদাস বলিল, মোটের ওপর তোমার বাবা অসঙ্গ ত কিছুই লেখেন নি। নিঃস্বার্থ পরোপকারের বিপদ আছে, অসুস্থ আত্মীয়কে সেবা করতে আসাটাও সংসারে সহজ কাজ নয়।
বন্দনা প্রশ্ন করিল, আমাকে কি আপনি মাসীর বাড়িতেই ফিরে যেতে বলেন?
সেই ত তোমার বাবার আদেশ বন্দনা। এ তো বলরামপুরের মুখুয্যেবাড়ি নয়—হুকুম দেওয়ার কর্তা এ ক্ষেত্রে তোমার মুখুয্যেমশাই নয়,—মাসী আবার আদেশটা দিয়েচেন বাপের মুখ দিয়ে, অতএব মান্য করতেই হবে।
বন্দনা বলিল, এ হলো আপনার মামুলি বচন। বাবা জানেন না কিছুই, তবু সেই আদেশ, ন্যায়-অন্যায় যাই হোক, শুনতে হবে? মাসীর বাড়িটি যে কি সে ত আপনি জানেন।
বিপ্রদাস কহিল, জানিনে, কিন্তু তোমার মুখে শুনেচি সে ভালো জায়গা নয়। আমি সুস্থ থাকলে নিজে গিয়ে তোমাকে বোম্বায়ে পৌঁছে দিয়ে আসতুম, কিন্তু সে শক্তি নেই।
এই অবস্থায় আপনাকে ফেলে চলে যাবো? যে মাসীকে চিনিনে তাঁর জিদটাই বড় হবে?
কিন্তু উপায় কি?
উপায় এই যে আমি যাবো না।
তবে থাকো। বাবাকে একটা তার করে দাও। কিন্তু মাসী নিতে এলে কি তাঁকে বলবে?
বন্দনা কহিল, যেতে পারবো না, শুধু এই কথাই বলবো। তার বেশি নয়।
বিপ্রদাস বলিল, তোমার মাসী কিন্তু এতেই নিরস্ত হবেন না। এবার হয়ত বাড়িতে আমার মাকে টেলিগ্রাম করবেন।
এ সম্ভাবনা বন্দনার মনে আসে নাই, শুনিয়া উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল, বলিল, আপনি ঠিকই বলছেন মুখুয্যেমশাই, হয়ত কাজটা শেষ হয়েই গেছে—খবর দিতে মাসীর বাকী নেই, কিন্তু কেন জানেন?
বিপ্রদাস কহিল, জানা ত সম্ভব নয়, তবে এটুকু আন্দাজ করা যেতে পারে যে এতখানি উদ্যম তাঁর নিঃস্বার্থ নয়, তোমার একান্ত কল্যাণের জন্যেও নয়; হয়ত কি একটা তাঁদের মনের মধ্যে আছে।
বন্দনা বলিল, কি আছে আমি জানি। ভাইপো এসেছেন ব্যারিস্টারি পাস করে,—মাসী দিয়েচেন আমাদের আলাপ-পরিচয় করিয়ে। দৃঢ় বিশ্বাস সে-ই আমার যোগ্য বর! কারণ বাবার আমি এক মেয়ে, যে সম্পত্তি তিনি রেখে যাবেন, তার আয়ে উপার্জন না করলেও ভাইপোর অনায়াসে চলে যাবে।
বিপ্রদাস বলিল, ভাইপোর কল্যাণ-চিন্তা করা পিসীর পক্ষ থেকে দোষের নয়। ছেলেটি দেখতে কেমন?
ভালো।
আমার মতো হবে?
বন্দনা হাসিয়া বলিল, এটি হলো আপনার অহঙ্কারের কথা। মনে বেশ জানেন এত রূপ সংসারে আর নেই। কিন্তু সে তুলনা করতে গেলে সংসারে সব মেয়েকেই যে আইবুড়ো থাকতে হয় মুখুয্যেমশাই। কেবল আপনার পানে চেয়েই তাদের দিন কাটাতে হয়। তবু বলবো দেখতে অশোককে ভালই, খুঁতখুঁত করা অন্ততঃ আমার সাজে না!