মাসীর ওপর রাগ নেই, কিন্তু আপনাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবো। ভয় নেই গাড়িভাড়া আমরাই দেবো, আপনার নিজের লাগবে না। এই বলিয়া বন্দনা হাসিয়া কহিল, ফিরতে আমার রাত হবে, কিন্তু সমস্ত ব্যবস্থা করে গেলুম, অন্যথা হলে এসে রাগ করবো।
করবে বৈ কি! না করলেই সকলে আশ্চর্য হবে। ভাববে, শরীর ভালো নেই, বিয়েবাড়িতে খেয়ে বোধ হয় অসুখ করেছে।
বন্দনা হাসিমুখে মাথা নাড়িয়া বলিল, হয়েছে আমার গুণ-ব্যাখ্যা করা; কিন্তু সে কথা যাক, আপনি সন্ধ্যে-আহ্নিক করতে নীচে যাবেন না যেন। অনুদি এই ঘরেই সব এনে দেবে। তার আধ-ঘণ্টা পরেই ঠাকুর দিয়ে যাবে খাবার, এক ঘণ্টা পরে ঝডু ওষুধ দিয়ে আলো নিবিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে যাবে। এই হুকুম সকলকে দিয়ে গেলুম। বুঝলেন?
হাঁ বুঝেছি।
তবে চললুম।
যাও। কিন্তু চমৎকার মানিয়েছে তোমাকে বন্দনা, এ কথা স্বীকার করবোই। কারণ, যে পোশাকটা পরেছো এইটেই হ’লো তোমার স্বাভাবিক, যেটা এখানে পরে থাকো সেটা কৃত্রিম।
সে কি কথা মুখুয্যেমশাই,—ওরা বলে মেয়েদের জুতো-পরা আপনি দেখতে পারেন না?
ওরা ভুল বলে, যেমন বলে তোমার হাতে আমি খেতে পারিনে।
বন্দনা বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল, ভুল হবে কেন মুখুয্যেমশাই, আমার হাতে খেতে সত্যিই ত আপনার আপত্তি ছিল।
বিপ্রদাস বলিল, আপত্তি ছিল, কিন্তু আপত্তিটা সত্যিকারের হলে সে আজও থাকতো, যেতো না।
কথাটা বন্দনা বুঝিল না, কিন্তু বিপ্রদাসের উক্তি অসত্য বলিয়া মনে করাও কঠিন, বলিল, দ্বিজুবাবু একদিন বলেছিলেন দাদার মনের কথা কেউ জানতে পারে না, যেটা শুধু বাইরের তাই কেবল লোকে টের পায়; কিন্তু যা অন্তরের তা অন্তরেই চাপা থাকে,—মুখুয্যেমশাই এ কি সত্যি?
উত্তরে বিপ্রদাস শুধু একটু হাসিল, তারপরে বলিল, বন্দনা, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। যদি সত্যিই থাকতে সেখানে ইচ্ছা না হয় থেকো না—চলে এসো।
চলেই আসবো মুখুয্যেমশাই, থাকতে সেখানে পারবো না। এই বলিয়া বন্দনা আর বিলম্ব না করিয়া নীচে নামিয়া গেল।
পরদিন সকালে দেখা হইলে বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করিল, বোনের বিয়ে নির্বিঘ্নে সমাধা হলো?
হাঁ হলো—বিঘ্ন কিছু ঘটেনি।
নিজের জিদই বজায় রইলো, মাসীর অনুরোধ রাখলে না? কত রাত্রে ফিরলে?
রাত্রি তখন তিনটে। মাসীর কথা রাখা চলল না। রাত্রেই ফিরতে হলো। একটুখানি থামিয়া বোধ হয় বন্দনা ভাবিয়া লইল বলা উচিত কিনা, তার পরেই সে বলিতে লাগিল, মাত্র কয়েক ঘণ্টা ছিলুম কিন্তু কাজ করে এসেচি অনেক। এক বছরে যা করতে পারিনি মিনিট পাঁচ-ছয়েই তা হয়ে গেল। সুধীরের সঙ্গে শেষ করে এলুম।
বিপ্রদাস আশ্চর্য হইয়া বলিল, বলো কি!
হ্যাঁ, তাই। কিন্তু ওকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে আসিনি। আজ সকালে যে মেয়েটিকে দেখেছিলেন তার নাম হেম। হেমনলিনী রায়। ওর জিম্মাতেই সুধীরকে দিয়ে এলুম। আবার আমার সেই বোম্বায়ের কলের কথাই মনে পড়ে, তার মতো ওদের ওখানেও ভালবাসার টানা-পোড়েনে দেখতে দেখতে মানুষের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে! আবার ভাঙ্গেও তেমনি।
বিপ্রদাস তেমনি বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল—ব্যাপারটা হলো কি? সুধীরের সঙ্গে হঠাৎ শেষ করে আসার মানে?
বন্দনা কহিল, শেষ করার মানে শেষ করা। কিন্তু তাই বলে ওখানে হঠাৎ বলেও কিছু নেই। ওদের তাল অসম্ভব দ্রুত বলেই বাইরে থেকে ‘হঠাৎ’ বলে ভ্রম হয়, কিন্তু আসলে তা নয়। সুধীর আমাকে ডেকে বললে আমার অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। বললুম, কি অন্যায় হয়েছে সুধীর? সে বললে, কাউকে না বলে—অর্থাৎ তাকে না জানিয়ে—অকস্মাৎ এ বাড়িতে চলে আসা আমার খুব গর্হিত কাজ হয়েছে। বিশেষতঃ, সেখানে বিপ্রদাসবাবু ছাড়া আর কেউ নেই যখন। বললুম, সেখানে অন্নদাদিদি আছে। সুধীর বললে, কিন্তু সে দাসী ছাড়া আর কিছু নয়। আমি বললুম, ও বাড়িতে তাঁকে দিদি বলে সবাই ডাকে। শুনে সেই হেম মেয়েটি মুখ টিপে একটু হেসে বললে, পাড়াগাঁয়ে ও-রকম ডাকার রীতি আছে শুনেচি, তাতে দাসী-চাকরের অহঙ্কার বাড়ে, আর কিছু বাড়ে না। তারা নিজেরাও বড় হয়ে ওঠে না।
সুধীর বললে, এঁদের কাছে তুমি বলেচো যে এখানে থাকতে পারবে না, রাত্রেই ফিরে যাবে; কিন্তু সে-বাড়িতে তোমার একলা থাকাটা আমরা কেউ পছন্দ করিনে। তোমার বাবা শুনলেই বা কি বলবেন? বললুম, বাবা কি বলবেন সে ভাবনা তোমার নয়, আমার। কিন্তু আরও যাঁরা পছন্দ করেন না তাঁদের মধ্যে কি তুমি নিজেও আছ? হেম বললে, নিশ্চয়ই আছেন! সকলকে ছাড়া ত উনি নয়। এই মেয়েটার গায়েপড়া মন্তব্যর উত্তর দিতে ইচ্ছে হল না, তাই সুধীরকে বললুম, তোমার এ কথার জবাবে আমিও বলতে পারতুম যে অনর্থক ছুটি নিয়ে তোমার কলকাতায় থাকাটা আমিও পছন্দ করিনে, কিন্তু সে কথা আমি বলব না। তুমি যে নোংরা ইঙ্গিত করলে তা ইতর-সমাজেই চলে, কিন্তু তোমাদের বড়-দলেও সে যে সমান সচল এ আমি জানতুম না, কিন্তু আর আমার সময় নেই, গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমি চললুম। সেই মেয়েটা বলে উঠল, যা অশোভন, যা অনুচিত তার আলোচনা ছোট-বড় সকল দলেই চলে জানবেন। বললুম, আপনার যত খুশি আলোচনা চালান আপত্তি নেই। আমি উঠলুম। সুধীর হঠাৎ কেমন ধারা যেন হয়ে গেল,—মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল,—নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, তোমার মাসীমাকেও জানিয়ে যাবে না? বললুম, তাঁকে জানানোই আছে বিয়ে হয়ে গেলেই আমি চলে যাবো যত রাতই হোক। সুধীর বললে, কাল তোমার সঙ্গে কি একবার দেখা হতে পারবে? বললুম, না। সে বললে, পরশু? বললুম, পরশুও না।