দ্বিজু বলিল, সে যাই হোক, তোমার আদেশ অমান্য করব না বৌদি,—তাঁদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলো।
সতী হাসিল, কহিল, আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্তই আছেন। ঘর থেকে বার হওয়া মাত্র তোমার দাদার কথা কানে গেল, তিনি জোর গলায় মাকে বলছিলেন, এবার নির্ভয়ে যাত্রার আয়োজন কর গে মা, যাঁকে দৌত্যকর্মে নিযুক্ত করা গেল তাঁর সুমুখে ভায়ার তর্ক চলবে না। ঘাড় হেঁট করে স্বীকার করবে, তুমি দেখে নিয়ো।
শুনিয়া দ্বিজদাস ক্রোধে ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া বলিল, অস্বীকার করতে পারব না জেনেই যদি তাঁরা এ ফন্দি এঁটে থাকেন যে মেয়েদের এই অর্থহীন খেয়াল চরিতার্থ করার বাহন আমাকেই হতে হবে, তা হলে আমার পক্ষ থেকে তুমি দাদাকে এই কথাটা বলো বৌদি, যে, তাঁদের লজ্জা হওয়া উচিত।
সতী কহিল, বলে লাভ নেই ঠাকুরপো, জমিদার হয়ে যারা প্রজার রক্ত শুষে খায়, এই তাদের নীতি। নিজের কাজ উদ্ধারের জন্য এদের কোন লজ্জাবোধ নেই। সম্পত্তির অর্ধেক মালিক হয়েও যখন তুমি এদের এস্টেট থেকে টাকা নিতে সঙ্কোচ বোধ কর, তখন একদিকে আমি যেমন দুঃখ পাই, তেমনি আর একদিকে মন খুশীতে ভরে ওঠে। তোমার নাম করে আমি মাকে আশ্বাস দিয়েছি যে, তাঁর যাওয়ার বিঘ্ন হবে না, সঙ্গে তুমি যাবে। তীর্থ থেকে ভালয় ভালয় ফিরে এসো ঠাকুরপো, যত লোকসানই তোমার হোক, আমি সবটুকু তার পূর্ণ করে দেব।
দ্বিজদাস নিঃশব্দে চৌকি হইতে উঠিয়া বৌদির পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া ফিরিয়া গিয়া বসিল।
সতী বলিল, এতক্ষণ পরের উমেদারি করেই ত সময় কাটল, এখন নিজের অনুরোধ একটা আছে।
দ্বিজদাস হাসিয়া কহিল, তোমার নিজের? ঐটি কিন্তু পারব না বৌদি!
সতী নিজেও হাসিল, বলিল, আশ্চর্য নয় ঠাকুরপো। ভয় হয় পাছে শুনে না বলে বসো।
বেশ ত, বলেই দেখো না।
সতী কহিল, আমার এক ম্লেচ্ছ খুড়ো আছেন,—আপনার নয়, বাবার খুড়তুত ভাই,—তিনি বিলাত গিয়েছিলেন। তখন এ খবরটা এঁদের কানে এসে পৌঁছলে এ বাড়িতে আমার ঢোকাই ঘটত না। মার মুখে এ কথা শুনেছ বোধ হয়?
বহু বার। এমন কি পড়পড়তা দিনে একবার করে হিসাব করে নিলে এই পনর-ষোল বছরে অন্ততঃ সংখ্যায় হাজার পাঁচ-ছয় হবে।
সতী হাসিয়া কহিল, আমারও আন্দাজ তাই। কাকা থাকেন বোম্বায়ে। তাঁর একটি মেয়ে ঐখানেই লেখাপড়া করে। আসচে বছরে সে বিলাত যাবে পড়া শেষ করতে। তোমাকে গিয়ে তাকে আনতে হবে।
কোথায়? বোম্বাই থেকে?
হাঁ। সে লিখেচে, সে একলাই আসতে পারে, কিন্তু এতটা দূর একাকী আসতে বলতে আমার সাহস হয় না।
তাঁকে পৌঁছে দেবার কেউ নেই?
না, কাকা ছুটি পাবেন না।
দ্বিজদাস হঠাৎ রাজি হইতে পারিল না, ভাবিতে লাগিল। সতী বলিতে লাগিল, আমার বিয়ে যখন হয় তখন সে সাত-আট বছরের বালিকা। তার পরে একটিবার মাত্র দেখা হয় কলকাতায়, তখন সে সবে ম্যাট্রিক পাস করে আই. এ. পড়তে শুরু করেছে,—সে ত কত বছর হয়ে গেল। তাকে আমি ভারী ভালবাসি ঠাকুরপো, যদি কষ্ট করে গিয়ে একবার এনে দাও। আনবার জন্যে সে আমাকে প্রায় চিঠি লেখে, কিন্তু সুযোগ আর হয় না।
দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু এখনোই বা সুযোগ হল কিসে? মা কি রাজি হয়েছেন?
সতী এ প্রশ্নের সহসা উত্তর দিতে পারিল না। এবং পারিল না বলিয়াই একটি সত্যকার ব্যাকুলতা তাহার মুখে প্রকাশ পাইল। একটুখানি থামিয়া কহিল, মাকে বলেছি। এখনো ঠিক মত দেননি বটে, কিন্তু নিজের তীর্থযাত্রা নিয়ে এমনি মেতে আছেন যে, আশা হয় আপত্তি করবেন না। তা ছাড়া নিজে যখন থাকবেন না তখন এই দু-তিন মাস সে অনায়াসে আমার কাছে থাকতে পারবে।
দ্বিজদাস মনে মনে বুঝিল, শাশুড়ীর হুকুম না পাইলেও এই সুযোগে সে প্রবাসী বোনটিকে একবার কাছে আনাইতে চায়। প্রশ্ন করিল, তোমার কাকারা কি ব্রাহ্ম-সমাজের?
সতী বলিল, না। কিন্তু হিন্দু-সমাজও তাদের আপনার বলে নেয় না। ওরা ঠিক যে কোথায় আছে নিজেরাও বোধ করি জানে না। এমনিভাবেই দিন কেটে যাচ্চে।
এ অবস্থা অনেকেরই। দ্বিজু মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, যেতে আমার আপত্তি নেই বৌদি, কিন্তু আমি বলি, মা থাকতে তাকে তুমি এখানে এনো না। মাকে ত জানই, হয়ত খাওয়া-ছোঁয়া নিয়ে এমন কাণ্ড করবেন যে, বোনকে নিয়ে তোমার লজ্জার সীমা থাকবে না। তার চেয়ে বরঞ্চ আমরা চলে গেলে তাঁকে আনার ব্যবস্থা করো—সব দিকেই ভাল হবে।
ইহা যে সুপরামর্শ তাহা সতী নিজেও জানিত, কিন্তু সে যখন নিজে চিঠি লিখিয়া আসিবার প্রার্থনা জানাইয়াছে, তখন কি করিয়া যে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় নিষেধ করিয়া চিঠির উত্তর দিবে তাহা ভাবিয়া পাইল না। ইহার সঙ্কোচ এবং দুঃখই কি কম? কহিল, নিজের বোন বলে বলচি নে ঠাকুরপো, কিন্তু সেবার মাস-খানেক তাকে কলকাতায় অত্যন্ত নিকটে পেয়ে নিশ্চয় বুঝেছি যে, রূপে-গুণে তেমন মেয়ে সংসারে দুর্লভ। বাইরে থেকে তাদের আচার-ব্যবহার যেমনই দেখাক, মা যদি তাকে দুটো দিনও কাছে কাছে দেখতে পান ত ম্লেচ্ছ মেয়েদের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা বদলে যাবে। কখনো তাকে অশ্রদ্ধা করতে পারবেন না।
দ্বিজদাস বলিল, কিন্তু এই দুটো দিনই যে মাকে দেখানো শক্ত বৌদি। তিনি দেখতেই চাইবেন না। ইহাও সত্য।
সতী কহিল, কিন্তু তার রূপটাও ত চোখে পড়বে? চোখ বুজে ত মা এটা অস্বীকার করতে পারবেন না! সেও ত একটা পরিচয়।
দ্বিজদাস চুপ করিয়া রহিল। সতী কহিল, আমার নিশ্চয় বিশ্বাস বন্দনাকে পৃথিবীতে কেউ অবহেলা করতে পারে না। মাও না।