দ্বিজদাস তৎক্ষণাৎ অস্বীকার করিয়া কহিল, আপনি তো জানেন, ঠাকুর-দেবতায় আমার বিশ্বাস নেই। তা ছাড়া আমার সঙ্গে উনি বৈকুণ্ঠে যেতেও নারাজ, এ ত তাঁর নিজের মুখ থেকেই শুনলেন।
বিপ্রদাস বিরক্ত হইয়া কহিলেন, হাঁ রে পণ্ডিত, শুনলাম। তুই যেতে পারবি কি না তাই বল।
আমার এখন মরবার ফুরসুত নেই। এই বলিয়া দ্বিজদাস অন্য প্রশ্নের পূর্বেই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।
বিপ্রদাস নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তাই বটে। এমনি দেশের কাজ যে মাকেও মানা চলে না।
এইখানে মায়ের একটুখানি পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। বিপ্রদাসের ইনি বিমাতা। তাঁহার জননীর মৃত্যুর বৎসর-কাল পরেই যজ্ঞেশ্বর দয়াময়ীকে বিবাহ করিয়া গৃহে আনিয়াছিলেন এবং সেইদিন হইতে ইঁহার হাতেই সে মানুষ। ইনি যে জননী নহেন এ সংবাদ বিপ্রদাস যথেষ্ট বয়স না হওয়া পর্যন্ত জানিতেও পারে নাই।
বিপ্রদাস – ০৩
তিন
এ বাড়িতে দ্বিজদাস সবচেয়ে বেশী খাতির করিত বৌদিদিকে। তাহার সর্ববিধ বাজে খরচের টাকাও আসিত তাঁহারই বাক্স হইতে। সতী শুধু সম্পর্ক-হিসাবেই তাহার বড় ছিল না, বয়সের হিসাবেও মাস-কয়েকের বড় ছিল। তাই অধিকাংশ সময়েই তাহাকে নাম ধরিয়া ডাকিত। এই লইয়া ছেলেবেলায় দ্বিজু মায়ের কাছে কত যে নালিশ জানাইয়াছে তাহার সংখ্যা নাই।
মাত্র এগারো বছর বয়সে সতী বধূরূপে এই গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল বলিয়া তাহার আদরের সীমা ছিল না। শাশুড়ী হাসিয়া বলিতেন, সত্যি নাকি? কিন্তু এ ত তোমার বড় অন্যায় বৌমা, দেওরের নাম ধরে ডাকা!
সতী বলিত, অন্যায় কেন, আমি যে ওর চেয়ে বয়সে অনেক বড়।
অনেক বড়? কত বড় মা?
আমি জন্মেছি বোশেখ মাসে, ও জন্মেচে ভাদ্র মাসে।
মা সহাস্যে কহিতেন, ভাদ্র মাসেই ত বটে মা, আমারই মনে ছিল না। এর পরেও আর যদি কখনো ও নালিশ করতে আসে ওর কান মলে দেব।
আদালতে হারিয়া দ্বিজু রাগ করিয়া চলিয়া গেলে বধূকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া শাশুড়ী সস্নেহে বলিতেন, ও ছেলেমানুষ কিনা তাই বোঝে না। ঠাকুরপো বললে ভারী খুশী হয়! মাঝে মাঝে ডেকো, কেমন মা?
সতী রাজী হইয়া ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিয়াছিল, আচ্ছা মা, মাঝে মাঝে তাই বলে ডাকবো।
সেদিন যে ছিল বালিকা, আজ সে এত বড় বাড়ির গৃহিণী। বিধবা হওয়ার পর হইতে শাশুড়ী ত থাকেন নিজের জপ-তপ এবং ধর্মকর্ম লইয়া, তথাপি তাঁহার সেদিনের সেই উপদেশটুকু পরবর্তীকালে সতীর অনেক দিন অনেক কাজে লাগিয়াছে। যেমন আজ।
পূর্ব পরিচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনার পরে প্রায় পনর- ষোল দিন অতীত হইয়াছে, সকালবেলা সতী দেবরের পড়িবার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতে করিতে ডাকিল, ভাই ঠাকুরপো—
দ্বিজদাস হাত তুলিয়া থামাইয়া দিয়া বলিল, থাক বৌদি, আর খোশামোদের আবশ্যক নেই, আমি করব।
কি করবে শুনি?
তুমি যা হুকুম করবে তাই। কিন্তু দাদার এ ভারী অন্যায়।
অন্যায়টা কিসের হল বলো ত?
দ্বিজদাস তেমনি রাগ করিয়াই কহিল, আমি জানি। এই মাএ দাদার ঘরের সুমুখ দিয়ে এসেচি। ভেতরে তিনি, মা এবং তোমার ষড়যন্ত্র যা হচ্চিল আমার কানে গেছে। তাঁদের সাহস নেই আমাকে বলেন, তাই তোমাকে ধরেছেন কাজ আদায়ের জন্যে। কত বড় অন্যায় বল ত!
সতী হাসিমুখে কহিল, অন্যায় ত নয় ঠাকুরপো। তাঁরা বেশ জানেন যে তাঁরা বলা মাএই জবাব আসবে, আমার মরবার ফুরসত নেই—কিন্তু বৌদিদি হুকুম করলে দ্বিজুর সাধ্য নেই যে না বলে।
দ্বিজদাস ঘাড় নাড়িয়া কহিল, এইখানেই হয়েছে আমার মুশকিল, আর এইখানেই পেয়েচেন ওঁরা
জোর। কিন্তু কি করতে হবে?
সতী বলিল, মা কৈলাস-দর্শনে যাবেনই, আর তোমাকে তাঁর সঙ্গে যেতে হবে।
দ্বিজদাস কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, দু-তিন মাসের কমে হবে না। কাজের কত ক্ষতি হবে ভেবে দেখেচো বৌদি?
সতী স্বীকার করিয়া বলিল, ক্ষতি কিছু হবেই। কিন্তু একটা নতুন জায়গাও দেখা হবে। নিজের তরফ থেকে একে নিছক লোকসান বলা চলে না। লক্ষ্মী ভাইটি, পরে যেন আর আপত্তি করো না।
দ্বিজদাস কহিল, তুমি যখন আদেশ করেছ, তখন আপত্তি আর করব না, সঙ্গে যাব। কিন্তু মা অনায়াসে সেদিন দাদাকে বলেছিলেন, আমার কলকাতার পড়ার খরচ বন্ধ করে দিতে।
সতী সহাস্যে বলিল, ওটা রাগের কথা ভাই। কিন্তু হুকুম যিনি দিলেন, তিনি মা ছাড়া আর কেউ নয়। এ কথাটাও তোমার ভুললে চলবে না।
দ্বিজদাস উত্তর দিল, ভুলিনি বৌদি। কিন্তু সেদিন থেকে আমিও কি স্থির করেচি জান? আমি একলা মানুষ, বিয়ে করবার আমার কখনো সময়ও হবে না, সুযোগও ঘটবে না। সুতরাং খরচ সামান্য। আবশ্যক হলে বরঞ্চ ছেলে পড়িয়ে খাব, কিন্তু এদের এস্টেট থেকে একটা পয়সাও কোনদিন চাইব না।
সতী পুনরায় হাসিয়া কহিল, চাইবার দরকার হবে না ঠাকুরপো, আপনি এসে হাজির হবে। আর তাও যদি না আসে তোমার ছেলে পড়াবার প্রয়োজন হবে না। অন্ততঃ, আমি বেঁচে থাকতে ত নয়। সে ভার আমার রইল।
এ বিশ্বাস দ্বিজুরও মনের মধ্যে স্বতঃসিদ্ধের ন্যায় ছিল,পলকের জন্য তাহার চোখের পাতা ভারী হইয়া উঠিল, কিন্তু সে ভাবটা তাড়াতাড়ি কাটাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এঁরা কবে যাত্রা করবেন স্থির করেছেন? যবেই করুন, শেষকালে আমাকেই সঙ্গে যেতে হল! অথচ মা সেদিন স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে আমার মত ম্লেচ্ছাচারীকে নিয়ে তিনি বৈকুণ্ঠে যেতেও রাজি নন। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস, না বৌদি?
সতী এ অনুযোগের জবাব দিল না, চুপ করিয়া রহিল।