গোলোক আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন, তোমার উপরেই ভরসা। আমাকে ত এখন একরকম গেরস্ত-সন্ন্যাসী বললেই হয়—তোমার বৌঠাকরুনের মৃত্যুর পর থেকে টাকাকড়ি, বিষয়-আশয় একেবারে বিষ হয়ে গেছে। কেবল ঐ নাবালক ছেলেটার জন্যে—তা টাকায় টাকা উতোর পড়বে বলে মনে হয় না?
চোঙদার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়! কিন্তু টাকাটা পিটবে এবার আহম্মদ সাহেব। সাত-শোর কন্টাক্টো পেয়েচে—আরও বেশী পেতো, শুধু সাহস করলে না টাকার অভাবে।
গোলোক চোখের একটা ইঙ্গিত করিয়া প্রশ্ন করিলেন, বড় নাকি?
চোঙদার বলিলেন, হুঁ, নইলে আমি ছেড়ে দিই!
গোলোক ডান হাতটা মুখের সম্মুখে তুলিয়া বলিয়া উঠিলেন, দুর্গা দুর্গা, রাম রাম! সক্কালবেলায় ও-কথা কি মুখে উচ্চারণ করতে আছে হে চোঙদার! জাতে ম্লেচ্ছ, ধর্মাধর্ম জ্ঞান নেই—তা হাজার দশেক টাকা মারবে বলে মনে হয় না?
চোঙদার কহিলেন, বেশি! বেশি!
গোলোক বলিলেন, লড়াইটা বেশীদিন চললে ব্যাটা দেখচি লাল হয়ে যাবে। তাই ত হে!
চোঙদার কহিলেন, নিঃসন্দেহ। তবে, বহুত টাকার খেলা—একসঙ্গে জোটাতে পারলে হয়।
গোলোক কহিলেন, কনটাক্টো দেখিয়ে কর্জ করবে—শক্ত হবে কেন?
চোঙদার মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিলেন, তা বটে, কিন্তু পেলে হয়। আমাকে বলছিল কিনা।
খবর শুনিয়া গোলোক উৎসুক হইয়া উঠিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, বলছিল নাকি? সুদ কি দিতে চায়?
চোঙদার কহিলেন, চার পয়সা ত বটেই। হয়ত—
এই ‘হয়ত’—টাকে গোলোক শেষ করিতে দিলেন না। রাগ করিয়া বলিলেন, চার পয়সা! টাকায় টাকা মারবে, আর সুদের বেলায় চার পয়সা! দশ আনা ছ’ আনা হয়ত, না হয় একবার দেখা করতে বলো।
চোঙদার কিছু আশ্চর্য হইয়াই জিজ্ঞাসা করিল, টাকাটা আপনিই দেবেন নাকি সাহেবকে? কথাটা কিন্তু জানাজানি হয়ে গেলে—
মুহূর্তে গোলোক নিজেকে সাবধান করিয়া লইয়া একটু শুষ্ক হাস্য করিয়া বলিলেন, রাধামাধব! তুমি ক্ষেপলে চোঙদার! বরঞ্চ, পারি ত নিষেধ করেই দেব। আর জানাজানির মধ্যে ত তুমি আর আমি। কিন্তু তাও বলি, টাকা ধার ও নেবেই, নিয়ে বাপের শ্রাদ্ধ করবে, কি বাই-নাচ দেবে, কি গরু চালান দেবে, তাতে মহাজনের কি? এই বলিয়া তাহার মুখের প্রতি সম্মতির জন্য ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া নিজেই বলিলেন, তা নয় চোঙদার, শুধু একটা কথার কথা বলচি যে, অত খোঁজ নিতে গেলে মহাজনের চলে না; কিন্তু আমাকে ত চিরকাল দেখে আসচ, ব্রাহ্মণের ছেলে, ধর্মপথে থেকে ভিক্ষে করি সে ভালো, কিন্তু অধর্মের পয়সা যেন কখনো না ছুঁতে হয়। কেবল তাঁর পদেই চিরদিন মতি স্থির রেখেচি বলেই আজ পাঁচখানা গ্রামের সমাজপতি। আজ মুখের একটা কথায় বামুনকে শূদ্দুর, শূদ্দুরকে বামুনের দলে তুলে দিতে পারি। মধুসূদন! তুমিই ভরসা! সেবার সেই ভারী অসুখে জয়গোপাল ডাক্তার বললে, সোডার জল আপনাকে খেতেই হবে। আমি বললুম, ডাক্তার, জন্মালেই মরতে হবে সেটা কিছু বেশী কথা নয়, কিন্তু গোলোক চাটুয্যেকে ও-কথা যেন আর দ্বিতীয়বার না কানে শুনতে হয়। কেনারামের পুত্র হররাম চাটুয্যের পৌত্রযাঁর একবিন্দু পাদোদকের আশায় স্বয়ং ভাঁড়ারহাটির রাজাকেও পালকি-বেহারা পাঠিয়ে দিতে হ’ত।
চোঙদার দ্বিতীয়বার প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, ও-কথা কে আর অস্বীকার করবে বলুন—ও ত পৃথিবীসুদ্ধ লোকে জানে।
গোলোক প্রত্যুত্তরে শুধু কেবল একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, মধুসূদন! তুমিই ভরসা!
চোঙদার প্রস্থানের উপক্রম করিতে তিনি ডাকিয়া কহিলেন, আর দেখ, হরেনের কাছ থেকে এলে, রেলের রসিদটা দেখিয়ে যেয়ো।
চোঙদার ঘাড় নাড়িয়া কহিল, যে আজ্ঞে।
গোলোক কহিলেন, তা হলে আট শ আর পাঁচ শ হলো! বাকী রইল সতের শ—মাসতিনেক সময় আছে—হয়ে যাবে, কি বল হে?
চোঙদার বলিলেন, আজ্ঞে হয়ে যাবে বৈ কি।
গোলোক কহিলেন, তাই তোমাকে তখনই বলেছিলুম চোঙদার, একেবারে ওটা পুরোপুরি হাজার-পাঁচেকের কন্টাক্টোই করে ফেল। তখন সাহস করলে না—
চোঙদার কহিলেন, আজ্ঞে, অতগুলো ছাগল-ভেড়া যদি যোগাড় না হয়ে ওঠে—
গোলোক প্রতিবাদ করিলেন না, কহিলেন, তাই ভাল, তাই ভাল। ধর্মপথে একের জায়গায় আধ, আধের জায়গায় সিকি হয় সেও ঢের, কিন্তু অধর্মের পথে মোহরও কিছু নয়। বুঝলে না চোঙদার? মধুসূদন! তুমিই ভরসা!
চোঙদার আর কিছু না বলিয়া প্রস্থান করিলে ভগবদ্ভক্ত গৃহস্থ-সন্ন্যাসী চাটুয্যেমহাশয় দগ্ধ হুঁকাটা তুলিয়া লইয়া চিন্তিতমুখে তামাক টানিতে লাগিলেন, বিষয়কর্ম বোধ করি বা বিষের মতই বোধ হইতে লাগিল, কিন্তু এমনি সময়ে অন্দরের দিকের কবাটটা ঈষৎ উদ্ঘাটিত করিয়া দাসী মুখ বাড়াইয়া কহিল, মাসীমা একবার ভেতরে ডাকচেন।
গোলোক চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন বল্ ত সদু?
দাসী কহিল, একটুখানি জলখাবার নিয়ে বসে আছেন মাসীমা।
গোলোক হুঁকাটা রাখিয়া দিয়া একটু হাস্য করিয়া বলিলেন, তোর মাসীর জ্বালায় আর আমি পারিনে সদু। পর্বদিনটায় যে একবেলা উপবাস করব সে বুঝি তার সইল না! এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং যাইতে যাইতে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া গেলেন, সংসারে থেকে পরকালের দুটো কাজ করার কতই না বিঘ্ন! মধুসূদন! হরি!
বামুনের মেয়ে – ১.৪
ঘ
সন্ধ্যার শরীরটা কিছুদিন হইতে তেমন ভাল চলিতেছিল না। প্রায়ই জ্বর হইত, এবং পিতার চিকিৎসাধীনে থাকিয়া সে যেন ধীরে ধীরে মন্দের দিকেই পথ করিতেছিল। মা বিপিন ডাক্তারকে ডাকিয়া পাঠাইবেন বলিয়া প্রত্যহ ভয় দেখাইতেছিলেন, এবং এই লইয়া মাতায়-কন্যায় একটু না একটু কলহ প্রায় প্রতিদিনই ঘটিতেছিল। আজ সায়াহ্নবেলায় সন্ধ্যা সম্মুখের বারান্দায় একটি খুঁটি ঠেস দিয়া বসিয়া মাতৃ-প্রদত্ত সাগুর বাটিটা চোখ বুজিয়া নিঃশেষ করিল এবং তাড়াতাড়ি একটি পান মুখে পুরিয়া দিয়া কোনমতে সেগুলার ঊর্ধ্বগতি নিবারণ করিল। এই খাদ্যবস্তুটার প্রতি তাহার অতিশয় বিতৃষ্ণা ছিল, কিন্তু তথাপি না খাওয়া এবং কম খাওয়া লইয়া আর তাহার কথা সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা হইল না।