সে করুণকণ্ঠে কহিল, কিন্তু আমি ত চিরকাল এখানে থাকতে পারিনে চাটুয্যেমশায়। লোকেই বা বলবে কি বলুন?
গোলোক দুই চক্ষু দৃপ্ত করিয়া কহিলেন, লোকে বলবে তোমাকে? এই গাঁয়ে বাস করে? ইহার অধিক কথা আর তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইল না, হওয়ার প্রয়োজনও ছিল না।
জ্ঞানদা নিজেও ইহা জানিত, তাই সে চুপ করিয়া রহিল।
গোলোক কহিতে লাগিলেন, আমার কথায় কথা কইলে তাকে আর কোথাও বাস করতে হবে—এ গাঁয়ে হবে না। সে বড় ভাবিনে, ভাবি কেবল ছেলেটার জন্যে। সে নাকি তোমাকে বড্ড ভালবাসত, তাই মরবার সময় তার সন্তানকে তোমারই হাতে দিয়ে গেল; কৈ আমার হাতে দিলে না?
জ্ঞানদা কষ্টে অশ্রু সংবরণ করিয়া কহিল, সব ত বুঝি চাটুয্যেমশায়, কিন্তু আমার বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ী যে এখনো বেঁচে রয়েচেন! আমি ছাড়া যে তাঁদের গতি নেই।
গোলোক তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিলেন, না গতি নেই! তুমিও যেমন! হাঁ, মুখুয্যে বেঁচে থাকত ত একটা কথা ছিল; কিন্তু তাকে ত চোখেও দেখনি। তের বছরে বিধবা হয়েচ—
জ্ঞানদা বলিল, হ’লাম বা বিধবা, চাটুয্যেমশাই—শ্বশুর-শাশুড়ী যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন তাঁদের সেবা আমাকে করতেই হবে।
গোলোক ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া একটা গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, তবে যাও আমাদের সব ভাসিয়ে দিয়ে। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখ ছোটগিন্নী—
জ্ঞানদা রাগ করিয়া বলিয়া উঠিল, আবার ছোটগিন্নী! বলেচি না আপনাকে, লোকে হাসি-তামাশা করে। কেন, নাম ধরে ডাকতে কি হয়?
গোলোক মুখখানা ঈষৎ প্রফুল্ল করিয়া বলিলেন, করলেই বা তামাশা ছোটগিন্নী? সম্পর্কটাই যে হাসি-তামাশার!
জ্ঞানদা হঠাৎ একটু হাসিয়া ফেলিয়া তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হইয়া বলিল, না, তা হবে না, আপনি চিরকাল নাম ধরে ডেকেছেন—তাই ডাকবেন।
গোলোক কহিলেন, আচ্ছা, আচ্ছা, তাই হবে। বলিয়া দেখিতে দেখিতে তাঁহার শ্মশ্রুগুম্ফহীন মুখখানা বিষাদে আচ্ছন্ন হইয়া উঠিল; ধীরে ধীরে একটা উচ্ছ্বসিত নিশ্বাস চাপিয়া ফেলিয়া কতকটা যেন নিজের মনে বলিতে লাগিলেন, বুকের মধ্যে দিবারাত্রি হু হু করে জ্বলে যাচ্চে—হায়রে! আমার আবার হাসি, আমার আবার তামাশা! তবে মাঝে মাঝে—তা যাক, নাই বললুম। কেউ অসন্তোষ হয়, জীবনে যা করিনি, আজই কি তা করব? বিষয় বিষ! সংসার বিষ! কবে তোমার শ্রীচরণে একটু আশ্রয় পাব! মধুসূদন!
জ্ঞানদা ছলছল চক্ষে নীরবে চাহিয়া রহিল। গোলোক বলিতে লাগিলেন, আবার জ্বালার ওপর জ্বালা, এর ওপর দিনরাত ঘটকের উৎপাত। তারা সবই জানে, লুকোতে পারিনে, বলি—কথা তোমাদের মানি, কুলীনের কুল কুলীনকেই রাখতে হয় এও জানি, আবার শোকে-তাপে অকালে-অসময়ে চুলগুলো পেকেচে তাও সত্যি, কিন্তু তবু ত পাকা চুল! এ নিয়ে আবার বিবাহ করা, আবার একটা বন্ধন ঘাড়ে করা সাজে, না মানায়? তুমি বল না ছোটগিন্নী?
জ্ঞানদা শুষ্ক একটুখানি হাসিয়া কহিল, বেশ ত, করুন না একটি বিয়ে।
গোলোক কহিলেন, ক্ষ্যাপা না পাগল! আবার বিয়ে! লক্ষ্মীর মত তুমি যার ঘরে আছ—যতই বল না, অনাথ বোনপোটাকে ভাসিয়ে যেতে পারবে না। যে মরণকালে হাতে তুলে দিয়ে গেছে—তার মান তোমাকে রাখতেই হবে, আমার আবার—কে?
ভৃত্য মুখ বাড়াইয়া সংবাদ দিল, চোঙদারমশাই এসেচেন।
গোলোক মুখখানা বিকৃত করিয়া কহিলেন, আঃ, আর পারিনে। কাজ, কাজ, বিষয়, বিষয়,—আমার যে এদিকে সব বিষ হয়ে গেছে, তা কাকেই বা বোঝাই, কে বা বোঝে! মধুসূদন! কবে নিস্তার করবে! যা না, দাঁড়িয়ে রইলি কেন, আসতে বল গে।
ভৃত্য অন্তর্হিত হইল, জ্ঞানদাও ও-দিকে দরজার বাহিরে গিয়া চাপাকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, এ বেলা কি তা হলে সত্যিই কিছু খাবেন না?
গোলোক মাথা নাড়িয়া কহিলেন, না। প্রভু গোকুল ঠাকুরের তিরোভাবের দিন একটা পর্বদিন। ছোটগিন্নী, আমাদের মত সেকেলে লোকগুলো আজও এসব মেনে চলে বলেই তবু এখনো চন্দ্র-সূর্য আকাশে উঠচে, জোয়ার-ভাটা নদীতে খেলচে। মধুসূদন! তোমারই ইচ্ছা!
জ্ঞানদা কহিল, তা হোক, একটু দুধ-গঙ্গাজল মুখে দিতে দোষ নেই। একটু শিগগির করে আসবেন, আমি নিয়ে বসে থাকব। এই বলিয়া সে অন্দরের কবাট রুদ্ধ করিয়া দিল।
সম্মুখের দ্বার দিয়া ভৃত্যের পশ্চাতে একজন ভদ্রব্যক্তি প্রবেশ করিলেন, গোলোক তাঁহাকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, এসো চোঙদার, বসো। ভেবে মরি, একটা খবর দিতেও কি পারো না? ভুলো, যা, শূদ্রের হুঁকোয় শিগগির জল করে তামাক নিয়ে আয়।
বিষ্ণু চোঙদার প্রণাম করিয়া গোলোকের পদধূলি লইয়া ফরাসের একধারে উপবেশন করিয়া প্রথমে একটা নিশ্বাস ফেলিলেন, তারপরে কহিলেন, দম ফেলবার ফুরসত ছিল না বড়কর্তা, তা খবর! যাক, পাঁচ শ আর তিন শ—এই আট শ জাহাজে তুলে দিয়ে তবে এলুম। আঃ—কি হাঙ্গামা!
দক্ষিণ আফ্রিকায় ছাগল ও ভেড়া চালান দিবার গোপন কারবারে এই বিষ্ণু চোঙদার ছিল তাঁহার অংশীদার। তিন মাসের মধ্যে তিন হাজার পশু যোগান দিবার শর্তে লেখাপড়া হইয়াছিল। তাই খবরটা শুনিয়া গোলোক খুশী হইলেন না। অপ্রসন্ন মুখে বলিলেন, মোটে আট শ। কনট্রাক্ট ত তিন হাজারের—এখনো ত ঢের বাকী হে! চোঙদার ক্ষুব্ধ হইয়া কহিলেন, ছাগল-ভেড়া কি আর পাওয়া যাচ্চে বড়কর্তা, সব চালান, সব চালান—এই আট শ যোগাড় করতেই যেন জিভ বেরিয়ে গেছে। তবু ত হরেন রামপুর থেকে চিঠি লিখেচে, আট-দশ দিনেই আরও পাঁচ-সাত শ রেলে পাঠাচ্চে—কেবল নাবিয়ে নিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া। আর সময় ত তিন মাসের—হয়েই যাবে নারায়ণের ইচ্ছেয়।