আজ্ঞে বড্ড বেদনা ঠাকুরমশাই।
আহা তা নয়, তা নয়। কি রকমের বেদনা? ঘর্ষণবৎ, না মর্ষণবৎ, সূচীবিদ্ধবৎ, না বৃশ্চিক-দংশনবৎ। কনকন করচে, না ঝনঝন করচে?
আজ্ঞে হাঁ, ঠাকুরমশাই, ঠিক ওই-রকম করচে।
তা হলে ঝনঝন করচে! ঠিক তাই! তারপরে?
তারপরে আর কি হবে ঠাকুরমশাই, কাল থেকে ব্যথায় মরে যাচ্চি—
থামো, থামো! কি বললে, মরে যাচ্চ?
রামময় অধীর হইয়া উঠিয়াছিল, কহিল, তা বৈ কি মুখুয্যেমশাই। খুঁড়িয়ে চলচি, পা ফেলতে পারিনে—আর মরা নয় ত কি! তা ছাড়া ছোঁড়াগুলো যে বজ্জাত,—কথা শোনে না, বারণ মানে না,—ওই তক্তাখানা নিয়েই তাদের যত খেলা। আবার কোন্দিন হয়ত আঁধারে পড়ে মরব দেখতে পাচ্চি। যা হয় একটু ওষুধ দিয়ে দেন ঠাকুরমশাই—ভারী বেলা হয়ে গেল!
বাবা, আর্নিকা দু’ ফোঁটা—
প্রিয়বাবু মেয়ের প্রতি চাহিয়া একটু হাস্য করিয়া বলিলেন, না মা, না। এ আর্নিকা কেস নয়। বিপ্নে হলে তাই দিয়ে দিত বটে। চার ফোঁটা একোনাইট তিরিশ শক্তি। দু’ঘণ্টা অন্তর খাবে।
সন্ধ্যা দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, একোনাইট বাবা? ”
হাঁ মা, হাঁ। মৃত্যুভয়! মৃত্যুভয়! পড়ে মরব! সিমিলিয়া সিমিলিবস্ কিউরেণ্টার! মহাত্মা হেরিং বলেচেন, রোগের নয়, রোগীর চিকিৎসা করবে। মৃত্যুভয়ে একোনাইট প্রধান। বিপ্নে হলেহুঁ:তবু, তবু হারামজাদারা চিকিৎসা করতে আসে! রামময়, শিশি নিয়ে যাও আমার মেয়ের সঙ্গে। দু’ঘণ্টা অন্তর চারবার খাবে। ও-বেলা গিয়ে দেখে আসব। ভাল কথা, পরাণে যদি এসে বলে, কৈ দেখি কি দিলে? খবরদার শিশি বার করো না বলে দিচ্ছি। হারামজাদা ঢকঢক করে হয়ত সবটা খেয়ে ফেলে আবার ক্যাস্টর অয়েল রেখে যাবে। উঃ—পেটটা মুচড়ে মুচড়ে উঠচে যে!
রামময়কে ঔষধ দিতে সন্ধ্যা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, ভয়ব্যাকুল-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ক্যাস্টর অয়েল অতখানি ত সব খেয়ে আসোনি বাবা?
নাঃ—উঃ—গাড়ুটা কৈ রে?
তবে বুঝি তুমি—
না—না—না—দে না শিগগির গাড়ুটা! পোড়া বাড়িতে যদি কোথাও কিছু পাওয়া যাবে! তবে থাকগে গাড়ু। বলিতে বলিতেই প্রিয়বাবু ঊর্ধ্বশ্বাসে খিড়কির দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
রামময় কহিল, দিদিঠাকরুন, ওষুধটা তা হলে—
সন্ধ্যা চকিত হইয়া বলিল, ওষুধ? হাঁ, এই যে দিই এনে।
এই যে তুমি বললে ‘আর্নি’ নাকি, তাই দু’ফোঁটা দিয়ে দাও দিদিঠাকরুন। মুখুয্যেমশায়ের ওষুধটা না হয়—
সন্ধ্যা অন্তরে ব্যথা পাইয়া কহিল, আমি কি বাবার চেয়ে বেশি বুঝি রামময়?
রামময় লজ্জিত হইয়া বলিল, না—তা না,—তবে মুখুয্যেমশায়ের ওষুধটা বড়ো জোর ওষুধ কিনা দিদিঠাকরুন,—আমি রোগা মানুষ—বরঞ্চ গিয়েই না হয় সাঁতেদের মেধোকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে পাঠিয়ে দেব—কাল থেকে তার পেট নাবাচ্চে,—দাঠাকুরের ওষুধ দিলেই ভাল হয়ে যাবে। আমাকে ঐ তোমার ওষুধটাই আজ দাও দিদিমণি।
সন্ধ্যা বিষণ্ণমুখে কহিল, আচ্ছা, এসো এইদিকে।
এই বলিয়া সে রামময়কে সঙ্গে লইয়া বারান্দা দিয়া পাশের একটা ঘরে চলিয়া গেল।
জগদ্ধাত্রী ঠাকুরঘরের জন্য এক ঘড়া জল আনিতে পুকুরে গিয়াছিলেন, বাড়ি ঢুকিয়াই জলপূর্ণ কলসীটা দাওয়ার উপর ধপ্ করিয়া বসাইয়া দিয়া ক্রুদ্ধস্বরে ডাক দিলেন, সন্ধ্যে?
সন্ধ্যা ঘরের মধ্য হইতে সাড়া দিল, যাই মা।
মা কহিলেন, তোর বাবা এখনো ফেরেনি? ঠাকুরপূজো আজ তা হলে বন্ধ থাক?
মেয়ে বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, বাবা ত অনেকক্ষণ এসেচেন মা। তেল মেখে নাইতে গেছেন।
কৈ, পুকুরে ত দেখলুম না?
তিনি যে কোথায় ছুটিয়া গেলেন সন্ধ্যা তাহা জানিত। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আজ বোধ হয় তা হলে নদীতে গেছেন। অনেকক্ষণ হলো, এলেন বলে।
জগদ্ধাত্রী কিছুমাত্র শান্ত হইলেন না, বরঞ্চ অধিকতর উত্তপ্তকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, এঁকে নিয়ে আর ত পারিনে, সন্ধ্যে, হয় উনিই কোথাও যান, না হয় আমিই কোথাও চলে যাই। বার বার বলে দিলুম, ভট্চায্যিমশাই আসতে পারবেন না, আজ একটু সকাল সকাল ফিরো। তবু এই বেলা—ঠাকুরের মাথায় একটু জল পর্যন্ত পড়তে পেলে না—তা ছাড়া কাল রাত্তিরে কি করে এসেছে জানিস? বিরাট পরামাণিকের সুদের সমস্ত টাকা মকুফ করে একেবারে রসিদ দিয়ে এসেচে।
সন্ধ্যা আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া কহিল, কে বললে মা?
কেন, বিরাটের নিজের বোনই বলে গেল যে। ভাজকে নিয়ে সে পুকুরে নাইতে এসেছিল।
সন্ধ্যা একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, ভাই-বোনে তাদের ঝগড়া মা, হয়ত কথাটা সত্যি নয়।
মা রাগিয়া বলিলেন, কেন তুই সব কথা ঢাকতে যাস বল দিকি সন্ধ্যে? জ্বর বলে বিরাট নাপতে ডেকে নিয়ে গেছে, ওষুধ খেয়েচে, ধন্বন্তরি বলে পায়ের ধূলো নিয়েচে, জমিদার বলে, গৌরী সেন বলে, ন্যাজ চুলকে দিয়েচে—তারা বলে আর হেসে লুটোপুটি! টাকা যাক, কিন্তু মনে হলো যেন আর ঘরে ফিরে কাজ নেই—ওই কলসীটাই আঁচলে জড়িয়ে পুকুরে ডুবে মরি। আজকাল যেন বড্ড বাড়িয়ে তুলেচে সন্ধ্যে, আমি সংসার চালাই বা কি করে বল্ দিকি?
কত টাকা মা?
কত! দশ-বারো টাকার কম নয় বললুম। একমুঠো টাকা কিনা স্বচ্ছন্দে—
কথাটা তাঁহার সমাপ্ত হইতে পাইল না। প্রিয়বাবু আর্দ্রবস্ত্রে ব্যতিব্যস্তভাবে বাড়ি ঢুকিতে ঢুকিতে চেঁচাইয়া ডাকিলেন, সন্ধ্যে, গামছা—গামছা—গামছাটা একবার দে দিকি মা। একোনাইট তিরিশ শক্তি—বাক্সর একেবারে কোণের দিকে— ৭৫৩
জগদ্ধাত্রী অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, একোনাইট ঘোচাচ্চি আমি। শ্বশুরের অন্নে জমিদার সাজতে লজ্জা করে না তোমার? কে বললে বিরাট নাপতেকে সুদ ছেড়ে দিতে। কার জায়গায় তুমি হাড়ী-দুলে এনে বসাও? কার জমি তুমি ‘গোচর’ বলে দান করে এসো? চিরটা কাল তুমি হাড়মাস আমার জ্বালিয়ে খেলে! আজ, হয় আমি চলে যাই, না হয়, তুমি আমার রাড়ি থেকে বার হয়ে যাও।