বকিতে বকিতে নাতিনীকে অগ্রবর্তী করিয়া রাসমণি প্রস্থান করিতেছিলেন, জগদ্ধাত্রী শঙ্কিত-বিরসমুখে কিছুক্ষণ সেইদিকে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ যেন তাঁহার চমক ভাঙ্গিয়া গেল। কহিলেন, ওমা খেঁদি, একটু দাঁড়া দিকি বাছা। ক্ষেত থেকে কাল একঝুড়ি নতুন মুক্তকেশী বেগুন, আর একটা কচি নাউ এসেছিল, তার গোটা কতক আর নাউয়ের একফালি সঙ্গে নিয়ে যা দিকি মা—আমি চট্ করে এনে দিই—
এই বলিয়া তিনি দ্রুতপদে বাটীর দিকে যাইতেছিলেন, রাসমণি পুলকিত বিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, ও মা, বেগুন বুঝি এরি মধ্যে উঠলো? বলিয়াই কণ্ঠস্বর একমুহূর্তে খাটো করিয়া নাতিনীকে কহিলেন, ওলো খেঁদি, মুখপোড়া মেয়ে! ঠুঁটোর মত দাঁড়িয়ে রইল, সঙ্গে সঙ্গে যা না! এবং পরক্ষণেই তাহাকে পিছন হইতে ডাকিয়া কহিলেন, ছুটে আসিস খেঁদি,—আমি ততক্ষণ একটু এগোই।
বামুনের মেয়ে – ১.২
খ
সম্মুখের একটা দাওয়ায় বসিয়া সন্ধ্যা নিবিষ্টচিত্তে সেলাই করিতেছিল, জগদ্ধাত্রী আহ্নিক সারিয়া পূজার ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ক্ষণকাল কন্যার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, সকাল থেকে কি অত সেলাই হচ্চে সন্ধ্যে, বেলা যে দুপুর বেজে গেছে —নাওয়া-খাওয়া করবি নে? পরশু সবে পথ্যি করেছিস, আবার কিন্তু পিত্তি পড়ে অসুখ হবে তা বলে দিচ্চি।
সন্ধ্যা দাঁত দিয়া বাড়তি সুতাটা কাটিয়া ফেলিয়া কহিল, বাবা যে এখনো আসেন নি মা।
তা জানি। কেবল বিনিপয়সার চিকিচ্ছে সারতে কত বেলা হবে সেইটে জানিনে। আর বেশ ত, আমি ত আছি, তোর উপোস করে থাকবার দরকারটা কি?
সন্ধ্যা নীরবে কাজ করিতে লাগিল, জবাব দিল না।
মা প্রশ্ন করিলেন, সেলাইটা কিসের হচ্ছে শুনি?
মেয়ে অনিচ্ছুক অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, এই দুটো বোতাম পরিয়ে দিচ্চি।
তা জানি মা, জানি। নইলে আমার কাপড়খানা সেরে রাখতে বসেচিস্ কি না তা জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু কি বাপ-সোহাগীই হয়েছিস সন্ধ্যে, যেন পৃথিবীতে ও আর কারও নেই! কোথায় একটা বোতাম নেই, কোথায় কাপড়ের কোণে একটু খোঁচা লেগেছে, কোন্ পিরানটায় একটু দাগ ধরেছে, জুতোজোড়াটার কোথায় একরতি সেলাই কেটেছে—এই নিয়েই দিবারাত্তির আছিস, এ ছাড়া সংসারে আর যেন কোন কাজ নেই তোর।
সন্ধ্যা মুখ তুলিয়া একটুখানি হাসিয়া কহিল, বাবার যে কিছু নজরে পড়ে না মা।
জবাব শুনিয়া মা খুশী হইলেন না, বলিলেন, পড়বে কি করে,—বিনিপয়সার ডাক্তারিতে সময় পেলে ত! বলি, দুলে মাগীরা গেলো?
যাবে বৈ কি মা।
কিন্তু সে কবে? ছোঁয়া-ন্যাপা করে জাতজন্ম ঘুচে গেলে, তারপরে? আবার যে বড়ো ছুঁচে সুতো পরাচ্চিস? উঠবি নে বুঝি?
তুমি যাও না মা, আমি এখুনি যাচ্ছি।
এই অসুখ শরীরে যা ইচ্ছে তুমি কর গে মা—তোমাদের দুজনের সঙ্গে বকতে বকতে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। সংসারে আর আমার দরকার নেই—এইবার আমি শাশুড়ীর কাছে গিয়ে কাশীবাস করব—তা কিন্তু তোমাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি।
এই বলিয়া জগদ্ধাত্রী ক্রোধভরে একটা পিতলের কলসী তুলিয়া লইয়া খিড়কির পুকুরের দিকে দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন।
সন্ধ্যা আনত-মুখে মুখ টিপিয়া শুধু একটু হাসিল, জননীর কোন কথার উত্তর দিল না। তাহার সেলাই প্রায় শেষ হইয়াছিল, ছুঁচ-সুতা প্রভৃতি এখনকার মত একটা ছোট সাবানের বাক্সে গুছাইয়া রাখিয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছিল, তাহার পিতার সোরগোলে চমকিয়া মুখ তুলিল। তিনি সদাই ব্যস্ত,—এইমাত্র বাড়ি ঢুকিয়াছেন, হাতে একটা হোমিওপ্যাথি ঔষধের ছোট বাক্স এবং বগলে চাপা কয়েকখানা ডাক্তারি বই। মেয়েকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন, সন্ধ্যে, ওঠ ত মা, চট্ করে আমার বড় ওষুধের বাক্সটা একবার,—কি যে করি কিছুই ভেবে পাইনে—এমনি মুশকিলের মধ্যে—
সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি উঠিয়া পিতার হাতের বাক্স ও বইগুলা লইয়া একধারে রাখিয়া দিল। বারান্দায় ইতিপূর্বে যে মাদুরখানি পাতিয়া রাখিয়াছিল, তাহারই উপর হাত ধরিয়া বসাইয়া দিয়া পাখার বাতাস করিতে করিতে বলিল, আজ কেন তোমার এত দেরি হলো বাবা?
দেরি! আমার কি নাবার-খাবার ফুরসত আছে তোরা ভাবিস? যে রোগীটির কাছে না যাব তারই রাগ, তারই অভিমান। প্রিয় মুখুয্যের হাতের একফোঁটা ওষুধ না পেলে যেন কেউ আর বাঁচবে না। ভয় যে নেহাত মিথ্যে তা যদিও বলতে পারিনে, কিন্তু প্রিয় মুখুয্যে ত একটাই—দুটো ত নয়! তাদের বলি—এই নন্দ মিত্তির লোকটা যা হোক একটু প্র্যাক্টিস ত করচে,—দু-একটা ওষুধও যে না জানে তা নয়,—কিন্তু তা হবে না। মুখুয্যেমশাইকে নইলে চলবে না। আর তাদের বা কি বলি! একটা বলি! একটা ওষুধের সিমটম যদি মুখস্থ করবে! আরে অত সহজ বিদ্যে নয়—অত সহজ নয়! তা হলে সবাই ডাক্তার হত। সবাই প্রিয় মুখুয্যে হত!
বাবা, জামাটা ছেড়ে ফেলো না—
ছাড়চি মা। এই আজই,—ধাঁ করে যে পল্সেটিলা দিয়ে ফেললি, প্র্যাক্টিস ত কচ্চিস, কিন্তু বল্ দেখি তার অ্যাকশন? দেখি, আমার মত কেমন তুই কণ্ঠস্থ বলে যেতে পারিস! সন্ধ্যে, ধর দিকি মা বইখানা, একবার পল্সেটিলাটা—
তোমার আবার বই কি হবে বাবা! আজ খাওয়া-দাওয়ার পরে ওই ওষুধটাই তোমার কাছে পড়ে নেব। দেবে পড়িয়ে বাবা?
দেব বৈ কি মা, দেব বৈ কি। নক্সের সঙ্গে তফাতটা হচ্চে আসলে—ওই বইখানা একবার—
তোমার পায়ে ততক্ষণ তেলটুকু মাখিয়ে দিই না বাবা? বড্ড বেলা হয়ে গেছে—মা আবার রাগ করবেন। বলিয়া সে একবার উদ্বিগ্ননেত্রে দেখিয়া লইল তাহার জননী ঘাট হইতে ফিরিতেছেন কিনা। এবং আপত্তি করিবার পূর্বেই তেলের বাটি হইতে খানিকটা তেল লইয়া বাবার পায়ে মাখাইয়া দিল।