রাসমণি প্রথমে অবাক্ হইলেন, পরে ক্রুদ্ধস্বরে বলিলেন, অমন মায়ার মুখে আগুন!
অকস্মাৎ সেই ক্রোধ অতি উচ্চ ধাপে চড়িয়া গেল এবং তাহারই সহিত কণ্ঠস্বরের সমতা রক্ষা করিয়া বলিতে লাগিলেন, ওই একগুঁয়ে ছোঁড়াটাকে কি তোরা সোজা বজ্জাত ঠাওরাস? অমন নচ্ছার গাঁয়ের মধ্যে আর দুটি নেই তোকে বলে দিলুম। চাটুয্যেদাদা একটা জমিদার মানুষ,—তিনি নিজে স্বয়ং ছোঁড়াটাকে ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, অরুণ, জলপানির লোভ দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে বসো গে যাও। বিলেতে যেয়ো না। কিন্তু কথাটা কি ছোঁড়া শুনলে? অত বড় একটা মানী লোকের মান রাখলে? উলটে ছোঁড়া নাকি বিলেতে যাবার সময় ঠাট্টা করে বলেছিল, বিলেতে গিয়ে জাত যায় আমার সেও ভাল, কিন্তু গোলোক চাটুয্যের মত বিলেতে পাঁঠা-ভেড়া চালান দিয়ে টাকা করতেও চাইনে, সমাজের মাথায় চড়ে, লোকের জাত মেরে বেড়াতেও পারব না। উঃ—আমি যদি সেখানে থাকতুম জগো, ঝেঁটিয়ে ছোঁড়ার মুখ সোজা করে দিতুম। যে গোলোক চাটু্য্যে—ভাত খেয়ে গোবর দিয়ে মুখ ধোয়, তাকে কিনা—
জগদ্ধাত্রী বিনীত-কণ্ঠে বলিতে গেলেন, কিন্তু অরুণ ত কখনো কারও নিন্দে করে না মাসী?
তবে বুঝি আমি মিছে কথা কইচি? চাটুয্যেদাদা বুঝি তবে—
না না, তিনি বলবেন কেন? তবে, লোকে নাকি অনেক কথা বানিয়ে বলে—
তোর এক কথা জগো। লোকের ত আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, তাই গেছে বানিয়ে বলতে। আচ্ছা, তাই বা বিলেতে গিয়ে কোন্ দিগ্গজ হয়ে এলি? শিখে এলি চাষার বিদ্যে! শুনে হেসে বাঁচিনে! চক্কোত্তিই হ, আর যাই হ, বামুনের ছেলে ত বটে! দেশে কি চাষী ছিল না? এখন তুই কি যাবি হালগরু নিয়ে মাঠে মাঠে লাঙ্গল দিতে! মরণ আর কি!
তাঁহার কণ্ঠস্বরের তীব্র সৌরভ ক্রমে ব্যাপ্ত হইবার উপক্রম করিতেছে, গন্ধ পাইয়া পাছে পাড়ার সমঝদার মধুমক্ষীর দল জুটিয়া যায়, এই ভয়ে জগদ্ধাত্রী আস্তে আস্তে বলিলেন, কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেন মাসী, একটু ভেতরে গিয়ে বসবে চল না?
না মা, বেলা গেল আর বসব না। মেয়েটাকেও ত আবার নাইয়ে-ধুইয়ে ঘরে তুলতে হবে। দুলি ছুড়ীটা বুঝি পালিয়েচে?
হাঁ ঠাকুমা, তোমরা যখন কথা কচ্ছিলে। কিন্তু সে আমাকে ছোঁয়নি—
ফের ‘নেই’ কচ্চিস হারামজাদী। কিন্তু জগো, ব্যাগত্তা করি বাছা, পাড়ার ভেতর আর হাড়ী-দুলে ঢোকাস নি। জামাইকে বলিস্।
বলব বৈ কি মাসী, আমি কালই ওদের দূর করে দেব। আর থাকলে ত আমাদের পুকুরঘাট সরবে, ওদের জল মাড়ামাড়ি করে আমাদেরই ত হাঁটতে হবে।
তবে, তাই বল্ না মা। তা হলে কি আর জাতজম্ম থাকবে? আমি ত সেই কথাই বলেছিলুম, কিন্তু আজকালকার মেয়ে-ছেলেরা নাকি কিছু মানতে চায়! তাই ত চাটুয্যেদাদা সেদিন শুনে অবাক্ হয়ে বললেন, রাসু, আমাদের জগদ্ধাত্রীর মেয়েটাকে নাকি তার বাপ লেখাপড়া শিখুচ্চে? তারা করচে কি! মানা করে দে—মানা করে দে—মেয়েছেলে লেখাপড়া শিখলে যে একেবারে গোল্লায় যাবে।
জগদ্ধাত্রী ভয়ের পরিসীমা রহিল না। কহিলেন, চাটুয্যেমামা বুঝি বলছিলেন?
বলবে না? সে হলো সমাজের মাথা, গাঁয়ের একটা জমিদার। তার কানে আর কোন্ কথাটা না ওঠে বল্। এই ত আমারও—ধর্ না কেন, বুড়ো হতে চললুম—লেখাপড়ার ত ধার ধারিনে, কিন্তু কোন্ শাস্তরটা না জানি বল্? কারও বাপের সাধ্যি আছে বলে, রাসি বামনি একটা অশাস্তর কাজ করেছে? এই যে মেয়েটা ছাগলদড়ি ডিঙোবা-মাত্তর শিউরে উঠে বললুম, ওলো ছুড়ী, করলি কি, আজ যে মঙ্গলবারের বারবেলা! কৈ কোন্ পণ্ডিত বলে যাক দিকি—না, এতে দোষ নেই! তা হবার জো নেই মা। তা হবার জো নেই। আমার বাপ-মায়ের কাছে শিক্ষে পেয়েছিলুম। কিন্তু ডাক দিকি তোমার লিখিয়ে-পড়িয়ে মেয়েকে কেমন বলতে পারে।
জগদ্ধাত্রী নিঃশব্দে ত্রুটি স্বীকার করিয়া কহিলেন, একটু বসলে হত না মাসী?
না মা, বেলা গেছে,—আর একদিন আসব। নে খেঁদী, বাড়ি চল্। এই বলিয়া নাতিনীকে অগ্রবর্তী করিয়া কয়েক পদ চলিয়া হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হাঁ জগো, অমন পাত্তরটি হাতছাড়া করলি কেন বল্ দেখি?
না হাতছাড়া ঠিক নয়, তবে কিনা ঘরবাড়ি কিছু নেই, বয়েস হয়েচে—তোমার জামায়ের যে মত হয় না বাছা।
রাসমণি বিস্ময়ে থমকিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, শোন কথা একবার! বলি, তার ঘর নেই, তোর ত আছে? তোর আর ছেলেও নেই, মেয়েও নেই যে তার জন্যে ভাবনা। এক মেয়ে, সেই মেয়ে-জামাই নিয়ে ঘর করতিস, সে কি অমন্দ হত বাছা? আর বয়েস? কুলীনের ছেলের চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর বয়েস কি আবার একটা বয়েস? রসিকপুরের জয়রাম মুখুয্যের দৌউত্তুর। তার আবার বয়েসের খোঁজ কে করে জগো? তা ছাড়া মেয়ের বয়েসের দিকেও একবার তাকা দিকিনি! আরও গড়িমসি করবি ত বিয়ে দিবি কবে? শেষে কি তোর ছোটপিসীর মত চিরটাকাল থুবড়ো রাখবি?
জগদ্ধাত্রী সলজ্জভাবে কহিলেন, আমিও ত তাই বলি মাসী, কিন্তু মেয়ের বাপ যে একেবারে—
কথাটাকে সম্পূর্ণ করিতে দিবার ধৈর্যও রাসমণির রহিল না। জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, মেয়ের বাপ বলবে না কেন? আহা! তাঁর নিজেরই যেন কত ঘর-বাড়ি জমিদারি ছিল! হাসালি বাপু তোরা! তা ছাড়া ঐ অরুণদের বৈঠকে দিনরাত বসা-দাঁড়ানো গানবাজনা করা—শুনি হুঁকো পর্যন্ত নাকি চলে যাচ্চে—ও-কথা সে বলবে না ত কি চাটুয্যেদাদা বলবে? হদ্দ করলি জগো! কিন্তু তাও বলে দিচ্চি বাছা, ঘর-বর যখন মিলেচে, তখন, না না করে দেরি করে শেষকালে অতিলোভে তাঁতি নষ্ট করিস নে। তোর ছোটপিসী গোলাপী থুবড়ো হয়ে মলো, তোর বাপের বড়, মেজ—দুই পিসীর বিয়েই হলো না। আর তোমার কি সময়ে বিয়ে হত বাছা, যদি না তোর বাপ-মা কাশীতে গিয়ে পড়ত? বেয়ান কাশীবাসিনী, কামড় কোমড় নেই, জামাই ইস্কুলে পড়চে—ঘর-বর যাই মিলে গেল, অমনি ধাঁ করে তোদের দু’হাত এক করে দিয়ে মেয়ে-জামাই নিয়ে দেশের লোক দেশে ফিরে এলো। ভাঙ্চির ভয়ে বিয়ের আগে কাউকে খবরটুকু পর্যন্ত দিলে না। তা ভালই করেছিল, নইলে বিয়ে হতই কিনা তাই বা কে জানে! নে খেঁদি, চল্! জয়রাম মুখুয্যের নাতি—তার আবার ঘরবাড়ি, তার আবার বয়স, তার আবার কালোধলোকালে কালে কতই শুনব। নে, এগো বাছা, আর দেরি করিস নে। কাপড়-চোপড় কাচতে, সন্ধ্যা দিয়ে আহ্নিক-মালা সারতে আজ দেখচি এক পহর রাত হয়ে যাবে। কিন্তু তাও বলি বাপু, খিস্টেন-ফিস্টেনকে বাড়ি ঢুকতে দেওয়া, মেয়ের সঙ্গে হাসি-তামাশা করতে দেওয়া ভাল নয়। কথাটা ঢিঢি হয়ে গেলে মেয়ের পাত্তর পাওয়া ভার হবে বাছা। নে না খেঁদি, চল্ না! পরের কথা পেলে তুই যে আর নড়তে চাসনে দেখি।