অরুণ অনিশ্চিত-কণ্ঠে সঙ্কোচের সহিত বলিল, কিন্তু এখন ত তোমার সঙ্গে আমি যেতে পারিনে সন্ধ্যা!
সন্ধ্যা চকিত হইয়া কহিল, কেন? তুমি সঙ্গে না গেলে আমি দাঁড়াব কোথায়? আমি বাঁচব কি করে?
এই আকুল প্রশ্নের জবাবটা অরুণ হঠাৎ খুঁজিয়া পাইল না; তারপরে অত্যন্ত ধীরে ধীরে বলিল, আজ আমাকে ক্ষমা কর সন্ধ্যা—আমাকে একটু ভাবতে দাও।
ভাবতে? এই বলিয়া সন্ধ্যা অবাক হইয়া একদৃষ্টে অরুণের প্রতি চাহিয়া বোধ করি বা অন্ধকারে যতদূর দেখা যায় তাহার মুখখানাই দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, তারপরে একটা গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আচ্ছা ভাবো। একটু নয়, বোধ হয় ভাববার সময় আজীবন পাবে। এতদিন আমিও ভেবেচি—দিনরাত ভেবেচি। যখন নিজের কাছে তোমাকে খুব ছোট করে দেখতে আমার বাধেনি, তখন এই কথাই ভেবেচি। আজ আবার তোমাদের ভাববার সময় এলো! আচ্ছা, চললুম,—বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেই তাহার অঙ্গের সুদীর্ঘ অঞ্চল স্খলিত হইয়া নীচে পড়িয়া গেল। তুলিয়া লইয়া ধীরে ধীরে যথাস্থানে স্থাপিত করিতে গিয়া এতক্ষণে তাহার নিজের প্রতি দৃষ্টি পড়িল।
অকস্মাৎ শিহরিয়া উঠিয়া কহিল, ভগবান! এই রাঙা চেলী, এই গায়ের গহনা, এই আমার কপালের কনে-চন্দন—এসব পরবার সময়ে এ কথা কে ভেবেছিল! বলিতে গিয়া তাহার কণ্ঠ ভাঙ্গিয়া আসিল, সেই ভাঙ্গা গলায় বলিল, আমি বিদায় হলাম অরুণদা। বলিয়া আর একবার প্রণাম করিয়া নীরবে বাহির হইয়া গেল।
অরুণ নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কিন্তু দৃষ্টির বাহিরে সন্ধ্যা অন্তর্হিত হইতেই হঠাৎ যেন তাহার চমক ভাঙ্গিয়া গেল—ব্যগ্র-ব্যাকুলকণ্ঠে চাকরটাকে বার বার ডাক দিয়া বলিতে লাগিল, শিবু, যা যা, সঙ্গে যা! বলিতে বলিতে সে নিজেই ছুটিয়া তাহার অনুসরণ করিল।
বামুনের মেয়ে – ২.৭ (শেষ)
ছ
বাঁ হাতে প্রদীপ লইয়া প্রিয় মুখুয্যে কি কয়েকটা বস্তু বাক্স হইতে বাছিয়া বাছিয়া একটুকরা কাপড়ে রাখিতেছিলেন, হঠাৎ পিছনে ডাক শুনিলেন, বাবা—
কাজটা প্রিয় গোপনেই করিতেছিলেন, শশব্যস্তে হাতের প্রদীপটা রাখিয়া দিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া সাড়া দিলেন, কে? সন্ধ্যা? এই যে মা, যাই চলে,—আর দেরী হবে না—
সন্ধ্যা কষ্টে অশ্রু সংবরণ করিয়া কহিল, কি করছিলে বাবা?
প্রিয় থতমত খাইয়া বলিলেন, আমি? কৈ না,—কিছুই ত নয় মা!
সেই বস্ত্রখণ্ডটা দেখাইয়া সন্ধ্যা জিজ্ঞাসা করিল, ওতে কি বাবা? কি রাখছিলে?
ধরা পড়িয়া প্রিয় অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া উঠিলেন; কতকটা মিনতির সুরে কহিলেন, গোটা-কতক—বেশী নয় মা, রেমিডি সঙ্গে নিচ্ছিলাম, আর ঐ মেটিরিয়া মেডিকাখানা—বড়টা নয়, ছোটটা—ছিঁড়ে-খুঁড়েও গেছে—অচেনা জায়গা, যা হোক একটু প্র্যাক্টিস্ করতে ত হবে! তাই ভাবলাম—
মা কি তোমাকে এটুকুও দিতে চায় না বাবা?
প্রিয় অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িয়া কি যে জানাইলেন, ঠিক বুঝা গেল না।
তুমি কোথায় প্র্যাক্টিস্ করবে বাবা?
বৃন্দাবনে। সেখানে কত যাত্রী যায় আসে—তাদের ওষুধ দিলে কি মাসে চার-পাঁচ টাকাও পাব না সন্ধ্যে? তা হলেই ত আমার বেশ চলে যাবে!
খুব পাবে বাবা, তুমি আরও ঢের বেশি পাবে। কিন্তু সেখানে ত তুমি কাউকে জানো না? পরশু শেষরাত্রে ঠাকুরমা যখন কাশী চলে গেলেন, তুমি কেন তাঁর সঙ্গে গেলে না বাবা?
মার সঙ্গে? কাশীতে? না মা, আর আমি কাউকে জড়াতে চাইনে। আমার জন্যে তোমরা অনেক দুঃখ পেলে, আর আমি কাউকে দুঃখ দেব না। যতদিন বাঁচব ঐ অচেনা জায়গায় একলাই থাকব।
সন্ধ্যা পিতার বুকের কাছে সরিয়া আসিয়া তাঁহার হাত-দুটি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া বলিল, কিন্তু আমি তোমাকে একলা থাকতে দেব না বাবা, আমি যে তোমার সঙ্গে যাব!
প্রিয় ধীরে ধীরে নিজের হাতটা ছাড়াইয়া লইয়া কন্যার মাথার উপর রাখিয়া হাসিয়া কহিলেন, দূর পাগলি, সে কি কখনো হয়? আমার সঙ্গে কোথায় যাবি মা,—তোমার মায়ের কাছে তুমি থাকো, সেও অনেক দুঃখ পেলে। আর আমার নাম করে যারা ওষুধ চাইতে আসবে, তাদের ওষুধ দিয়ো। আর দ্যাখ্ সন্ধ্যা, আমার বইগুলো যদি তোর মা দেয় ত বিপিনটাকে দিয়ে দিস। সে বেচারা গরীব, বই কিনতে পারে না বলেই কিছু শিখতে পারে না।
সন্ধ্যা মাথা নাড়িয়া বলিল, না বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাবই। এই দেখ না আমার পরনের কাপড়-দুটি আমি গামছায় বেঁধে নিয়েচি। এই বলিয়া সে অঞ্চলের ভিতর হইতে একটি ছোট পুঁটুলি বাহির করিয়া দেখাইল।
প্রিয় কোনদিনই বেশী প্রতিবাদ করিতে পারেন না, তিনি রাজী হইয়া বলিলেন, আচ্ছা, চল্, কিন্তু তোর মা যে বড় দুঃখ পাবে সন্ধ্যা।
কাল সর্বসমক্ষে, সমাজের ষোল আনার সম্মুখে পিতার উৎকট দুর্গতি সে চোখে দেখিয়াছে। জগদ্ধাত্রীর নিজের বাড়ি বলিয়াই এতটা সম্ভব হইতে পারিয়াছে—এ অপমান সন্ধ্যার হাড়ে হাড়ে বিঁধিয়াছে; কিন্তু প্রত্যুত্তরে তাহার কোন উল্লেখ করিল না, শুধু বার বার মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিল, না বাবা, আমি কিছুতেই থাকব না, আমি যাবই। আমি সঙ্গে না থাকলে কে তোমাকে দেখবে? কে তোমাকে রেঁধে দেবে?
এই বলিয়া সে তাড়াতাড়ি বাবার ঔষধগুলি ও বইখানি বস্ত্রখণ্ডে বাঁধিয়া ফেলিল, এবং তাহার হাত ধরিয়া কহিল, চল বাবা, আমরা এই বেলা বেরিয়ে পড়ি, নইলে বারোটার ট্রেন হয়ত ধরতে পারা যাবে না।
মায়ের রুদ্ধ-ঘরের চৌকাঠের উপর মাথা ঠেকাইয়া সন্ধ্যা প্রণাম করিয়া কহিল, মা, আমরা চললুম। কেবল দু’খানি পরনের কাপড় ছাড়া আর তোমার আমি কিচ্ছু নিইনি। বলিয়াই সে কাঁদিয়া ফেলিল, কিন্তু ভিতর হইতে কোন সাড়া আসিল না। তাড়াতাড়ি আঁচলে চোখ মুছিয়া বলিল, মা, লাঞ্ছনা আর ঘৃণার সমস্ত কালি মুখে মেখেই আমরা বিদায় নিলাম, তোমাদের সমাজে এর বিচার হবে না—কিন্তু যাদের মহাপাতকের বোঝা নিয়ে আজ আমাদের যেতে হলো তাদের বিচার করবার জন্যেও অন্ততঃ একজন আছেন, সে কিন্তু একদিন টের পাবে।
ঘরের অভ্যন্তর তেমনি নিস্তব্ধ, দ্বার তেমনি অবরুদ্ধ রহিল, সন্ধ্যা পিতার পিছনে পিছনে বাটীর বাহির হইয়া আসিল। কে একজন অদূরে গাছতলায় দাঁড়াইয়া ছিল, সে কাছে আসিতেই প্রিয় জ্যোৎস্নার আলোকে চিনিতে পারিয়া বলিলেন, কে অরুণ নাকি?