বৃদ্ধ সনাতন হাজরা বাটীর সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল, গোবিন্দ দেখিতে পাইয়া ডাকাডাকি, অনুনয়-বিনয়, শেষকালে একরকম জোর করিয়া ধরিয়া আনিয়া বেণীবাবুর সামনে হাজির করিয়া দিল। বেণী গরম হইয়া কহিল, এত দেমাক কবে থেকে হ’ল রে সনাতন? বলি, তোদের ঘাড়ে কি আজকাল আর একটা করে মাথা গজিয়েচে রে!
সনাতন কহিল, দুটো করে মাথা আর কার থাকে বড়বাবু? আপনাদের থাকে না, ত আমাদের মত গরীবের!
কি বললি রে! বলিয়া হাঁক দিয়া বেণী ক্রোধে নির্বাক হইয়া গেল; ইহারই সর্বস্ব যেদিন বেণীর হাতে বাঁধা ছিল, তখনই এই সনাতন দুবেলা আসিয়া বড়বাবুর পদলেহন করিয়া যাইত—আজ তাহারই মুখে এই কথা!
গোবিন্দ রসান দিয়া কহিল, তোদের বুকের পাটা শুধু দেখচি আমরা! মায়ের প্রসাদ পেতেও কেউ তোরা এলিনি, বলি কেন বল্ ত রে?
বুড়ো একটুখানি হাসিয়া কহিল, আর বুকের পাটা! যা করবার সে ত আপনারা আমার করেচেন। সে যাক, কিন্তু মায়ের প্রসাদই বলুন আর যাই বলুন, কোন কৈবর্তই আর বামুনবাড়িতে পাত পাতবে না। এত পাপ যে মা বসুমতী কেমন করে সইচেন, তাই আমরা কেবল বলাবলি করি, বলিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া সনাতন রমার প্রতি চাহিয়া কহিল, একটু সাবধানে থেকো দিদিঠাকরুন, পিরপুরের মোচলমান ছোঁড়ারা একেবারে ক্ষেপে রয়েচে। ছোটবাবু ফিরে এলে যে কি কাণ্ড হবে তা ঐ মা দুর্গাই জানেন। এর মধ্যেই দু-তিনবার তারা বড়বাবুর বাড়ির চারপাশে ঘুরে ফিরে গেছে—সামনে পায়নি তাই রক্ষে, বলিয়া সে বেণীর দিকে চাহিল। চক্ষের নিমেষে বেণীর ক্রুদ্ধ মুখ ভয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল।
সনাতন কহিতে লাগিল, ঠাকুরের সুমুখে মিথ্যে বলচি নে বড়বাবু, একটু সামলে-সুমলে থাকবেন। রাত-বিরেতে বার হবেন না—কে কোথায় ওত পেতে বসে থাকবে বলা যায় না ত!
বেণী কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না! তাহার মত ভীত লোক বোধ করি সংসারে ছিল না।
এতক্ষণে রমা কথা কহিল। স্নেহার্দ্র-করুণকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, সনাতন, ছোটবাবুর জন্যেই বুঝি তোমাদের সব এত রাগ?
সনাতন প্রতিমার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, মিথ্যে বলে আর নরকে যাব কেন দিদিঠাকরুন, তাই বটে! মোচলমানদের রাগটাই সবচেয়ে বেশি। তারা ছোটবাবুকে হিঁদুদের পয়গম্বর মনে করে। তার সাক্ষী দেখুন আপনারা—জাফর আলি, আঙ্গুল দিয়ে যার জল গলে না, সে ছোটবাবুর জেলের দিন তাদের ইস্কুলের জন্যে একটি হাজার টাকা দান করেচে। শুনি মসজিদে তাঁর নাম করে নাকি নেমাজপড়া পর্যন্ত হয়।
রমার শুষ্ক ম্লান মুখখানি অব্যক্ত আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। সে চুপ করিয়া প্রদীপ্ত নির্নিমেষ চোখে সনাতনের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। বেণী অকস্মাৎ সনাতনের হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, তোকে একবার দারোগার কাছে গিয়ে বলতে হবে সনাতন। তুই যা চাইবি তাই তোকে দেবো, দু বিঘে জমি ছাড়িয়ে নিতে চাস ত তাই পাবি, ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে দিব্যি করচি সনাতন, বামুনের কথাটা রাখ।
সনাতন বিস্মিতের মত কিছুক্ষণ বেণীর মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া কহিল, আর ক’টা দিন বা বাঁচব বড়বাবু! লোভে পড়ে যদি এ কাজ করি, মরলে আমাকে তোলা চুলোয় যাক, পা দিয়ে কেউ ছোঁবে না! সে দিনকাল আর নেই বড়বাবু, সে দিনকাল আর নেই! ছোটবাবু সব উল্টে দিয়ে গেছেন।
গোবিন্দ কহিল, বামুনের কথা তা হলে রাখবি নে বল্?
সনাতন মাথা নাড়িয়া বলিল, না। বললে তুমি রাগ করবে গাঙ্গুলীমশাই, কিন্তু সেদিন পিরপুরের নতুন ইস্কুলঘরে ছোটবাবু বলেছিলেন, গলায় গাছ-কতক সুতো ঝোলানো থাকলেই বামুন হয় না। আমি ত আর আজকের নয় ঠাকুর, সব জানি। যা ক’রে তুমি বেড়াও সে কি বামুনের কাজ? তোমাকেই জিজ্ঞাসা করচি দিদিঠাকরুন, তুমিই বল দেখি?
রমা নিরুত্তরে মাথা হেঁট করিল। সনাতন উৎসাহিত হইয়া মনের আক্রোশ মিটাইয়া বলিতে লাগিল, বিশেষ করে ছোঁড়াদের দল। ছোটবাবুর জেল হওয়া থেকে এই দুটো গাঁয়ের যত ছোকরা সন্ধ্যের পর সবাই গিয়ে জোটে জাফর আলির বাড়িতে। তারা ত চারিদিকে স্পষ্ট বলে বেড়াচ্চে, জমিদার ত ছোটবাবু। আর সব চোর-ডাকাত। তা ছাড়া খাজনা দিয়ে বাস করব—ভয় কারুকে করব না। আর বামুনের মত থাকে ত বামুন, না থাকে আমরাও যা, তারাও তাই।
বেণী আতঙ্কে পরিপূর্ণ হইয়া শুষ্কমুখে প্রশ্ন করিল, সনাতন, আমার ওপরেই তাদের এত রাগ কেন বলতে পারিস্?
সনাতন কহিল, রাগ ক’রো না বড়বাবু, কিন্তু আপনি যে সকল নষ্টের গোড়া তা তাদের জানতে বাকী নেই।
বেণী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ছোটলোক সনাতনের মুখে এমন কথাটা শুনিয়াও সে রাগ করিল না, কারণ, রাগ করিবার মত মনের অবস্থা তাহার ছিল না—তাহার বুকের ভিতর টিপ্টিপ্ করিতেছিল।
গোবিন্দ কহিল, তা হলে জাফরের বাড়িতেই আড্ডা বল্? সেখানে তারা কি করে বলতে পারিস্?
সনাতন তাঁহার মুখপানে চাহিয়া কি যেন চিন্তা করিল। শেষে কহিল, কি করে জানিনে, কিন্তু ভাল চাও ত সে মতলব ক’রো না ঠাকুর ! তারা হিন্দু-মুসলমান ভাই-সম্পর্ক পাতিয়েচে—এক মন, এক প্রাণ। ছোটবাবুর জেল হওয়া থেকে সব রাগে বারুদ হয়ে আছে, তার মধ্যে গিয়া চক্মকি ঠুকে আগুন জ্বালতে যেও না ঠাকুর!
সনাতন চলিয়া গেল, বহুক্ষণ পর্যন্ত কাহারও কথা কহিবার প্রবৃত্তি রহিল না। রমা উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিতে বেণী বলিয়া উঠিল, ব্যাপার শুনলে রমা?