মা বলিলেন, ‘বেশ’ বলে চুপ করে রইলি যে রে!
শেখর আবার হাসিয়া মুখ নিচু করিয়া বলিল, যা জিজ্ঞেস করলে তাই ত বললুম।
মা-ও হাসিলেন। বলিলেন, কৈ বললি? রঙ কেমন, ফরসা? কার মত হবে? আমাদের ললিতার মত?
শেখর মুখ তুলিয়া বলিল, ললিতা ত কালো মা, ওর চেয়ে ফরসা।
মুখচোখ কেমন?
তাও মন্দ নয়।
তবে কর্তাকে বলি?
এবার শেখর চুপ করিয়া রহিল।
মা ক্ষণকাল পুত্রের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিলেন, হাঁ রে, মেয়েটি লেখাপড়া শিখেচে কেমন?
শেখর বলিল, সে ত জিজ্ঞাসা করিনি মা!
অতিশয় আশ্চর্য হইয়া মা বলিলেন, জিজ্ঞেস করিসনি কি রে! যেটা আজকাল তোদের সবচেয়ে দরকারী জিনিস, সেইটেই জেনে আসিসনি?
শেখর হাসিয়া বলিল, না মা, ওকথা আমার মনেই ছিল না।
ছেলের কথা শুনিয়া এবার তিনি অতিশয় বিস্মিত হইয়া ক্ষণকাল তাহার মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, তবে তুই ওখানে বিয়ে করবি নে দেখচি!
শেখর কি একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু এই সময় ললিতাকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া চুপ করিয়া গেল। ললিতা ধীরে ধীরে ভুবনেশ্বরীর পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি বাঁ হাত দিয়া তাহাকে সুমুখের দিকে টানিয়া আনিয়া বলিলেন, কি মা?
ললিতা চুপি চুপি বলিল, কিচ্ছু না মা।
ললিতা পূর্বে ইঁহাকে মাসীমা বলিত, কিন্তু তিনি নিষেধ করিয়া দিয়া বলিয়াছিলেন, তোর আমি ত মাসী হইনে ললিতে,মা হই। তখন হইতে সে মা বলিয়া ডাকিত। ভুবনেশ্বরী তাহাকে বুকের আরো কাছে টানিয়া লইয়া আদর করিয়া বলিলেন,কিচ্ছু না? তবে বুঝি আমাকে শুধু একবার দেখতে এসেছিস?
ললিতা চুপ করিয়া রহিল।
শেখর কহিল, দেখতে এসেচে, রাঁধবে কখন?
মা বলিলেন, রাঁধবে কেন?
শেখর আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে তবে ওদের রাঁধবে মা? ওর মামাও ত সেদিন বললেন, ললিতাই রাঁধাবাড়া সব কাজ করবে।
মা হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, ওর মামার কি, যা হোক একটা বললেই হলো। ওর বিয়ে হয়নি, ওর হাতে খাবে কে? আমাদের বামুনঠাকরুনকে পাঠিয়ে দিয়েচি, তিনি রাঁধবেন। বড়বৌমা আমাদের রান্নাবান্না করচেন—আমি দুপুরবেলা ওদের বাড়িতেই আজকাল খাই।
শেখর বুঝিল, মা এই দুঃখী পরিবারের গুরুভার হাতে তুলিয়া লইয়াছেন।
সে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিল।
মাসখানেক পরে একদিন সন্ধ্যার পর শেখর নিজের ঘরে কোচের উপর কাত হইয়া একখানি ইংরাজী নভেল পড়িতেছিল। বেশ মন লাগিয়া গিয়াছিল, এমন সময় ললিতা ঘরে ঢুকিয়া বালিশের তলা হইতে চাবি লইয়া শব্দ-সাড়া করিয়া দেরাজ খুলিতে লাগিল। শেখর বই হইতে মুখ না তুলিয়াই বলিল, কি?
ললিতা বলিল, টাকা নিচ্চি।
হুঁ, বলিয়া শেখর পড়িতে লাগিল। ললিতা আঁচলে টাকা বাঁধিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। আজ সে সাজিয়া-গুজিয়া আসিয়াছিল, তাহার ইচ্ছা শেখর চাহিয়া দেখে। কহিল, দশ টাকা নিলুম শেখরদা।
শেখর ‘আচ্ছা’ বলিল, কিন্তু চাহিয়া দেখিল না। অগত্যা সে এটা-ওটা নাড়িতে লাগিল, মিছামিছি দেরি করিতে লাগিল, কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হইল না, তখন ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু গেলেই ত চলে না, আবার তাহাকে ফিরিয়া আসিয়া দোরগোড়ায় দাঁড়াইতে হইল। আজ তাহারা থিয়েটার দেখিতে যাইবে।
শেখরের বিনা হুকুমে সে যে কোথাও যাইতে পারে না, ইহা সে জানিত। কেহই তাহাকে ইহা বলিয়া দেয় নাই, কিংবা কেন, কি জন্য, এ-সব তর্কও কোনদিন মনে উঠে নাই। কিন্তু জীবমাত্রেরই যে একটা স্বাভাবিক সহজবুদ্ধি আছে, সেই বুদ্ধিই তাহাকে শিখাইয়া দিয়াছিল; অপরে যাহা ইচ্ছা করিতে পারে, যেখানে খুশি যাইতে পারে, কিন্তু সে পারে না। সে স্বাধীনও নয় এবং মামা-মামীর অনুমতিই তাহার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সে দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমরা যে থিয়েটার দেখতে যাচ্ছি।
তাহার মৃদুকণ্ঠ শেখরের কানে গেল না—সে জবাব দিল না।
ললিতা তখন আরো একটু গলা চড়াইয়া বলিল, সবাই আমার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েচে যে।
এবার শেখর শুনিতে পাইল, বইখানা একপাশে নামাইয়া রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হয়েচে?
ললিতা একটুখানি রুষ্টভাবে বলিল, এতক্ষণে বুঝি কানে গেল। আমরা থিয়েটারে যাচ্ছি যে।
শেখর বলিল, আমরা কারা?
আমি, আন্নাকালী, চারুবালা, তার মামা।
মামাটি কে?
ললিতা বলিল, তাঁর নাম গিরীনবাবু। পাঁচ-ছ’দিন হলো মুঙ্গেরের বাড়ি থেকে এসেচেন, এখানে বি. এ. পড়বেন—বেশ লোক সে—
বাঃ—নাম, ধাম, পেশা—এ যে দিব্যি আলাপ হয়ে গেছে দেখচি। তাতেই চার-পাঁচ দিন মাথার টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পাইনি—তাস খেলা হচ্ছিল বোধ করি?
হঠাৎ শেখরের কথা বলার ধরন দেখিয়া ললিতা ভয় পাইয়া গেল। সে মনেও করে নাই, এরূপ একটা প্রশ্নও উঠিতে পারে। সে চুপ করিয়া রহিল।
শেখর বলিল, এ ক’দিন খুব তাস চলছিল, না?
ললিতা ঢোক গিলিয়া মৃদুস্বরে কহিল, চারু বললে যে।
চারু বললে? কি বললে? বলিয়া শেখর মাথা তুলিয়া একবার চাহিয়া দেখিয়া কহিল, একেবারে কাপড় পরে তৈরি হয়ে আসা হয়েছে,—আচ্ছা যাও।
ললিতা গেল না, সেইখানেই চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
পাশের বাড়ির চারুবালা তাহার সমবয়সী এবং সই। তাহারা ব্রাহ্ম। শেখর ঐ গিরীনকে ছাড়া তাহাদের সকলকেই চিনিত। গিরীন পাঁচ-সাত বৎসর পূর্বে কিছুদিনের জন্য একবার এদিকে আসিয়াছিল। এতদিন বাঁকিপুরে পড়িত, কলিকাতায় আসিবার প্রয়োজনও হয় নাই, আসেও নাই। তাই শেখর তাহাকে চিনিত না। ললিতা তথাপি দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া বলিল, মিছে দাঁড়িয়ে রইলে কেন, যাও। বলিয়া মুখের সমুখেই বই তুলিয়া লইল।