বৃন্দাবন কহিল, ভুলতে পারিনি বলেই মাড়াই নে, পারলে হয়ত মাড়াতুম। যাক, কি কথা?
এমন করে তাড়া দিলে কি বলা যায়?
বৃন্দাবন হাসিল। তার পরে শান্তকণ্ঠে কহিল, তাড়া দিইনি, ভালভাবেই জানতে চাচ্চি। যেমন করে বললে সুবিধে হয়, বেশ ত তুমি তেমনি করেই বল না।
কুসুম কহিল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব বলে আমি অনেকদিন অপেক্ষা করে আছি–আমি চূল এলো করে, পথেঘাটে রূপ দেখিয়ে বেড়াই, এ কথা কে রটিয়েছিল?
তাহার প্রশ্ন শুনিয়া বৃন্দাবন ক্ষণকাল অবাক হইয়া থাকিয়া বলিল, আমি। তারপরে?
তুমি রটাবে এমন কথা আমি বলিনি, মনেও ভাবিনি, কিন্তু—
কথাটা শেষ করিতে না দিয়াই বৃন্দাবন বলিয়া উঠিল, কিন্তু সেদিন বলেওছিলে, ভেবেওছিলে। আমি বড়লোক হয়ে শুধু তোমাদের জব্দ করবার জন্যেই মাকে নিয়ে ভাইদের নিয়ে খেতে এসেছিলুম—সে পেরেচি, আজ আর পারিনে? সে অপরাধের সাজা আমার মাকে দিতে তুমিও ছাড়নি!
কুসুম নিরতিশয় ব্যথিত ও লজ্জিত হইয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমার কোটি কোটি অপরাধ হয়েচে। তখন তোমাকে আমি চিনতে পারিনি।
এখন পেরেছ?
কুসুম চুপ করিয়া রহিল।
বৃন্দাবনও চুপ করিয়া থাকিয়া সহসা বলিয়া উঠিল, ভাল কথা, একটা কুকুর রান্নাঘরে ঢুকে তোমার হাড়িঁকুড়িঁ রান্নাবান্না সমস্ত যে মেরে দিয়ে গেল।
কুসুম কিছুমাত্র উদ্বেগ বা চাঞ্চল্য প্রকাশ না করিয়া জবাব দিল, যাক গে। আমি ত খাবো না—আগে জানলে রাঁধতেই যেতুম না।
আজ একাদশী বুঝি?
কুসুম ঘাড় হেঁট করিয়া বলিল, জানিনে। ওসব আমি করিনে।
কর না?
কুসুম তেমনি অধোমুখে নিরুত্তর রহিল।
বৃন্দাবন সন্দিগ্ধস্বরে বলিল, আগে করতে, হঠাৎ ছাড়লে কেন?
পুনঃ পুনঃ আঘাতে কুসুম অধীর হইয়া উঠিতেছিল। উত্যক্ত হইয়া কহিল, করিনে আমার ইচ্ছে বলে। জেনে শুনে কেউ নিজের সর্বনাশ করতে চায় না, সেইজন্যে। দাদার ব্যবহার অসহ্য হয়েছে, কিন্তু সত্যি বলচি, তোমার ব্যবহারে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করচে।
বৃন্দাবন কহিল, সেটা করো না। আমার ব্যবহারের বিচার পরে হবে, না হলেও ক্ষতি নাই, কিন্তু দাদার ব্যবহার অসহ্য হল কেন?
কুসুম ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া জবাব দিল, সে আর এক মহাভারত– তোমাকে শোনাবার আমার ধৈর্য নেই। মোট কথা, তিনি নিজের বিষয়-সম্পত্তি ছেড়ে আর আমাকে দেখতে শুনতে পারবেন না—তাঁর শাশুড়ির হুকুম নেই। খেতে পরতে দেওয়া বন্ধ করেচেন, চরণ তার মায়ের ভার না নিলে অনেকদিন আগেই আমাকে শুকিয়ে মরতে হতো। এখন আমি—সহসা সে থামিয়া গিয়া ভাবিয়া দেখিল, আর বলা উচিত কি না। তারপর বলিল, এখন আমি তোমাদের সম্পূর্ণ গলগ্রহ। তাই একদিন একদন্ডও এখানে আর থাকতে চাইনে।
বৃন্দাবন সহাস্যে প্রশ্ন করিল, তাই থাকতে ইচ্ছে নেই?
কুসুম একটিবার চোখ তুলিয়াই মুখ নিচু করিল। এই সহজ সহাস্য প্রশ্নের মধ্যে যতখানি খোঁচা ছিল, তাহার সমস্তটাই তাহাকে গভীরভাবে বিদ্ধ করিল।
বৃন্দাবন বলিল, চরণ তার মায়ের ভার নিশ্চয়ই নেবে, কিন্তু কোথায় থাকতে চাও তুমি?
কুসুম তেমনি নতমুখেই বলিল, কি করে জানব? তাঁরাই জানেন।
তাঁরা কে?–আমি?
কুসুম মৌনমুখে সম্মতি জানাইল।
বৃন্দাবন কহিল, সে হয় না। আমি তোমার কোন বিষয়েই হাত দিতে পারিনে। পারেন শুধু মা। তুমি যেমন আচরণই তাঁর সঙ্গে করে থাক না কেন, চরণের হাত ধরে যাও তাঁর কাছে—উপায় তিনি করে দেবেনই। কিন্তু, তোমার দাদা?
কুসুমের চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। মুছিয়া বলিল, বলেচি ত আমার দাদা মরে গেছেন। কিন্তু কি করে আমি দিনের বেলা পায়ে হেঁটে ভিক্ষুকের মত গ্রামে গিয়ে ঢুকব?
বৃন্দাবন বলিল, তা জানিনে, কিন্তু পারলে ভাল হত। এ ছাড়া আর কোন সোজা পথ আমি দেখতে পাইনে।
কুসুম ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া বলিল, আমি যাব না।
খুশি তোমার।
সংক্ষিপ্ত সরল উত্তর। ইহাতে নিহিত অর্থ বা কিছুমাত্র অস্পষ্টতা নাই। এতক্ষণে কুসুম সত্যই ভয় পাইল।
বৃন্দাবন আর কিছু বলে কি না, শুনিবার জন্য কয়েক মুহূর্ত সে উদ্গ্রীব হইয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল, তাহার পর অতিশয় নম্র ও কুণ্ঠিতভাবে ধীরে ধীরে বলিল, কিন্তু এখানেও আমার যে আর দাঁড়াবার স্থান নেই। আমি দাদার দোষও দিতে চাইনে, কেননা নিজের অনিষ্ট করে পরের ভালো না করতে চাইলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না, কিন্তু তুমি ত অমন করে ঝেড়ে ফেলে দিতে পার না?
বৃন্দাবন কোন উত্তর না দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বেলা হল। চরণ, তুই থাকবি, না যাবি রে? থাকবি? আচ্ছা থাক্। তোমার ইচ্ছে হলে যেয়ো। আমার বিশ্বাস, ও-বাড়িতে ওর হাত ধরে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তোমার খুব মস্ত অপমান হতো না। যাক চললুম, বলিয়া পা বাড়াইতে কুসুম সহসা চরণকে কোল হইতে নামাইয়া দিয়া সোজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আজ সমস্ত বুঝলুম।
আমার এত বড় দুঃখের কথা মুখ ফুটে জানাতেও যখন দাঁড়িয়ে উঠে জবাব দিলে, বেলা হল চললুম, আমি কত নিরাশ্রয় তা স্পষ্ট বুঝেও যখন আশ্রয় দিতে চাইলে না, তখন তোমাকে বলবার বা আশা করবার আর কিছু নেই। তবু আরও একটা কথা জিজ্ঞেস করব, বল, সত্যি জবাব দেবে?
বৃন্দাবন ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিয়া বলিল, দেব। আমি আশ্রয় দিতে অস্বীকার করিনি, বরং তুমিই নিতে বারংবার অস্বীকার করেচ।
কুসুম দৃঢ়কণ্ঠে কহিল, মিছে কথা। আমার কপালের দোষে কি যে দুর্মতি হয়েছিল—মার মনে আঘাত দিয়ে একবার গুরুতর অপরাধ করে আমার মা, স্বামী, পুত্র, ঘরবাড়ি সব থাকতেও আজ আমি পরের গলগ্রহ, নিরাশ্রয়। আজ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির মুখ দেখতে পাইনি। অপরাধ আমার যত ভয়ানকই হোক, তবু ত আমি সে—বাড়ির বৌ। কি করে সেখানে আমাকে ভিখিরীর মত, দিনের বেলা সমস্ত লোকের সুমুখ দিয়ে পায়ে হেঁটে, পাঠাতে চাচ্চ? তুমি আর কোন সোজা পথ দেখতে পাওনি। কেন পাওনি জান? আমরা বড় দুঃখী, আমার মা ভিক্ষা করে আমাদের ভাই-বোন দুটিকে মানুষ করেছিলেন, দাদা উঞ্ছবৃত্তি করে দিনপাত করেন, তাই তুমি ভেবেচ, ভিখিরীর মেয়ে ভিখিরীর মতই যাবে, সে আর বেশি কথা কি! এ শুধু তোমার মস্ত ভুল নয়, অসহ্য দর্প। আমি বরং এইখানে না খেয়ে শুকিয়ে মরব, তবু তোমার কাছে হাত পেতে তোমার হাসি-কৌতুকের আর মালমসলা যুগিয়ে দেব না।