ভারতী বলিল, দাদা, তোমার কথা শুনলে গা কাঁপে। রাজশক্তিকে যে তুমি দগ্ধ করতে চাও, তার ইন্ধন ত আমাদেরই দেশের লোক। এতবড় লঙ্কাকাণ্ডের কল্পনায় কি তোমার মনে করুণাও জাগে না?
প্রত্যুত্তরে লেশমাত্র দ্বিধা নাই, ডাক্তার স্বচ্ছন্দে কহিলেন, না। প্রায়শ্চিত্ত কথাটা কি শুধু মুখেরই কথা? পূর্ব-পিতামহগণের যুগান্তসঞ্চিত পাপের অপরিমেয় স্তূপ নিঃশেষ হবে কিসে বলতে পারো? করুণার চেয়ে ন্যায়ধর্ম ঢের বড় বস্তু, ভারতী।
ভারতী ব্যথা পাইয়া বলিল, এ তোমার সেই পুরানো কথা দাদা। ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তুমি যে কত নিষ্ঠুর হতে পারো তা যেন আমি ভাবতেই পারিনে। রক্তপাত ছাড়া আর কিছু যেন মনে তোমার জাগতেই পায় না। রক্তপাতের জবাব যদি রক্তপাতই হয়, তা হলে তারও ত জবাব রক্তপাত? এবং তারও ত জবাবে এই একই রক্তপাত ছাড়া আর কিছু মেলে না। এ প্রশ্নোত্তর ত সেই আদিম কাল থেকে হয়ে আসচে। তবে কি মানবের সভ্যতা এর চেয়ে বড় উত্তর কোন দিন দিতে পারবে না? দেশ গেছে, কিন্তু তার চেয়েও যে বড় সেই মানুষ ত আজও আছে। মানুষে মানুষে কি হানাহানি না করে কোনমতেই পাশাপাশি বাস করতে পারে না?
ডাক্তার কহিলেন, ইংরাজের একজন বড় কবি বলেছেন, পশ্চিম ও পূর্ব কোনদিনই মিলতে মিশতে পারে না।
ভারতী রুষ্ট হইয়া কহিল, ছাই কবি। বলুক গে সে। তুমি পরম জ্ঞানী, তোমাকে অনেকবার জিজ্ঞেসা করেচি, আজও জিজ্ঞেসা করচি, হোক তারা পশ্চিমের, হোক তারা ইউরোপের মানুষ, কিন্তু তবু ত মানুষ? মানুষের সঙ্গে মানুষে কি কিছুতেই বন্ধুত্ব করতে পারে না? দাদা, আমি ক্রীশ্চান, ইংরাজের কাছে আমি বহু ঋণে ঋণী, তাদের অনেক সদ্গুণ আমি নিজের চোখে দেখেচি,—তাদের এত মন্দ ভাবতে আমার বুকে শূল বেঁধে। কিন্তু আমাকে তুমি ভুল বুঝো না দাদা, আমি বাঙালী ঘরেরই মেয়ে,—তোমারই বোন। বাঙলার মাটি, বাঙলার মানুষকে আমি প্রাণাধিক ভালবাসি। কে জানে, যে জীবন তুমি বেছে নিয়েছ, হয়ত আজই আমাদের শেষ দেখা। আজ আমাকে, তুমি শান্তমনে এই জবাবটি দিয়ে যাও, যেন এরই দিকে চোখ রেখে আমি সারা জীবন মুখ তুলে সোজা চলে যেতে পারি। বলিতে বলিতে শেষের দিকে তাহার কণ্ঠস্বর কান্নার ভারে একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল।
ডাক্তার নীরবে তরী বাহিতে লাগিলেন। বিলম্ব দেখিয়া ভারতীর মনে হইল, বোধ হয় তিনি ইহার উত্তর দিতে চান না। সে হাত বাড়াইয়া নদীর জলে চোখ-মুখ ধুইয়া ফেলিল, অঞ্চল দিয়া বার বার ভাল করিয়া মুছিয়া পুনরায় কি একটা প্রশ্ন করিতেছিল, ডাক্তার কথা কহিলেন।
স্নিগ্ধ মৃদুকণ্ঠ, কোথাও লেশমাত্র উত্তেজনা বা বিদ্বেষের আভাস নাই,—যেন কাহার কথা কে বলিতেছে এমনি শান্ত সহজ। ভারতীর সেই প্রথম পরিচয়-দিনের স্কুলের নিরীহ নির্বোধ মাস্টার মহাশয়টিকে মনে পড়িল। অশুদ্ধ ইংরাজি উচ্চারণ, ব্যাকরণও তেমনি,—ভারতী কষ্টে হাসি চাপিয়া আলাপ করিয়াছিল। পরে তাই লইয়া রাগ করিয়া সে ডাক্তারকে অনেক দিন অনেক তিরস্কার করিয়াছে। সেই নিরুৎসুক নিঃস্পৃহকণ্ঠে কহিলেন, এক রকমের সাপ আছে, ভারতী, তারা সাপ খেয়েই জীবনধারণ করে। দেখেচ?
ভারতী বলিল, না দেখিনি, শুনেচি।
ডাক্তার বলিলেন, পশুশালায় আছে। এবার কলকাতায় গিয়ে অপূর্বকে হুকুম করো, সে দেখিয়ে আনবে।
বার বার ঠাট্টা করো না দাদা, ভাল হবে না বলচি।
না, ভাল হবে না আমিও তাই বলচি। পাশাপাশি বাস করাটা ঠিক ঘটে ওঠে না বটে, কিন্তু আর ও ঘনিষ্ঠভাবে একজনের জঠরের মধ্যে আর একজন বেশ নিরাপদেই স্থান পায়। বিশ্বাস না হয় জু’র অধ্যক্ষকে জিজ্ঞেসা করে দেখো।
ভারতী চুপ করিয়া রহিল।
ডাক্তার বলিলেন, তুমি তাদের সমধর্মাবলম্বী, তাদের কাছে অশেষ ঋণে ঋণী, তাদের অনেক সদ্গুণ চোখে দেখেচ,—দেখেচ তাদের বিশ্বগ্রাসী বিরাট ক্ষুধার পরিমাণ? এ দেশের মালিক তারা,—মালিকানার তারিখ মনে আছে ত? আজ ব্রিটিশ-সম্পদের তুলনা হয় না। কত জাহাজ, কত কল-কারখানা, কত শত-সহস্র ইমারত। মানুষ মারবার উপকরণ-আয়োজনের আর অন্ত নেই। তার সমস্ত অভাব, সর্বপ্রকার প্রয়োজন মিটিয়েও ইংরেজ ১৮১০ সাল থেকে সত্তর বছরের মধ্যে কেবল বাইরে দিয়েছিল ঋণ তিন হাজার কোটি টাকা! জানো এই বিরাট ঐশ্বর্যের উৎস কোথায়? আপনাকে তুমি বাঙলা দেশের মেয়ে বলছিলে, না? বাঙলার মাটি, বাঙলার জলবায়ু, বাঙলার মানুষ তোমার প্রাণাধিক প্রিয়, না? এই বাঙলার দশ লক্ষ নর-নারী প্রতি বৎসরে শুধু ম্যালেরিয়া জ্বরে মরে। এক-একটা যুদ্ধজাহাজের দাম জানো? এর একটার খরচে কেবল দশ লক্ষ মায়ের চোখের জল চিরদিনের তরে মোছানো যায়। ভেবেছ কখনো এ কথা? দেখেচ কখনো বুকের মধ্যে মায়ের মূর্তি? শিল্প গেল, বাণিজ্য গেল, ধর্ম গেল, জ্ঞান গেল,—নদীর বুক বুজে মরুভূমি হয়ে উঠছে, চাষা পেট পুরে খেতে পায় না, শিল্পী বিদেশীর দুয়ারে মজুরি করে,—দেশে জল নেই, অন্ন নেই, গৃহস্থের সর্বোত্তম সম্পদ সে গোধন নেই,—দুধের অভাবে শিশুদের শুকিয়ে মরতে দেখেচ ভারতী?
ভারতী চীৎকার করিয়া থামাইতে চাহিল, কিন্তু গলা দিয়া তাহার শুধু একটা অস্ফুট শব্দ বাহির হইল মাত্র।
সব্যসাচীর সেই ধীর সংযত কণ্ঠস্বর কোন্ একসময়ে অন্তর্হিত হইয়াছিল, বলিলেন, তুমি ক্রীশ্চান, মনে পড়ে একদিন কৌতূহলবশে ইউরোপের ক্রীশ্চান সভ্যতার স্বরূপ জানতে চেয়েছিলে? সেদিন ব্যথা দেবার ভয়ে বলিনি, কিন্তু আজ তার উত্তর দেব। তোমাদের কেতাবে কি আছে জানিনে, শুনেচি ভাল কথা ঢের আছে, কিন্তু বহুদিন একসঙ্গে বসবাস করে এর সত্যকার চেহারা আর আমার এতটুকু অগোচর নেই। লজ্জাহীন উলঙ্গ স্বার্থ এবং পশু-শক্তির একান্ত প্রাধান্যই এর মূলমন্ত্র। সভ্যতার নাম দিয়ে দুর্বল, অক্ষমের বিরুদ্ধে এতবড় মুষল মানুষের বুদ্ধি আর ইতিপূর্বে আবিষ্কার করেনি। পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে চেয়ে দেখ, ইউরোপের বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা থেকে কোন দুর্বল জাতিই আজ আর আত্মরক্ষা করতে পারেনি।
দেশের মাটি, দেশের সম্পদ থেকে দেশের ছেলেরা বঞ্চিত হয়েছে কোন্ অপরাধে জানো ভারতী? একমাত্র শক্তিহীনতার অপরাধে। অথচ ন্যায়ধর্মই সকলের বড়, এবং বিজিতের অশেষ কল্যাণের জন্যেই এই অধীনতার শৃঙ্খল তার পায়ে পরিয়ে সেই পঙ্গুর সর্বপ্রকার দায়িত্ব বহন করাই ইউরোপীয় সভ্যতার চরম কর্তব্য,—এই পরম অসত্য লেখায়, বক্তৃতায়, মিশনারির ধর্মপ্রচারে, ছেলেদের পাঠ্যপুস্তকে অবিশ্রান্ত প্রচার করাই তোমাদের ক্রীশ্চান সভ্যতার রাজনীতি।