জোয়ার তখনও আরম্ভ হয় নাই, কিন্তু ভাঁটার টানে ঢিমা পড়িয়া আসিয়াছে। সেই মন্দীভূত স্রোতে উচ্চ তীরভূমির অন্ধকার ছায়ার নীচে দিয়া তাহাদের ক্ষুদ্র তরণী ধীরে ধীরে পিছাইয়া চলিতে লাগিল। ও-পারের জন্য পাড়ি দিতে তখনও বিলম্ব ছিল, ডাক্তার হাতের দাঁড় যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া স্থির হইয়া বসিলেন।
শ্রান্ত ভারতী তাঁহার ক্রোড়ের উপর কনুই রাখিয়া হেলান দিয়া বসিয়া বলিল, আজ একলা থাকলে আমি এমন কান্না কাঁদতাম যে নদীর জল বেড়ে যেতো। দাদা, ভবিষ্যতে সকলেরই সুখী হবার অধিকার আছে, নেই কি কেবল তোমার? শশীবাবু অতবড় বিশ্রী কাজ করতে উদ্যত, তাকেও তুমি মন খুলে আশীর্বাদ করে এলে,—শুধু কেউ নেই পৃথিবীতে সুখী হও বলে তোমাকেই আশীর্বাদ করবার? তুমি গুরুজন হও আর যাই হও, তোমাকেও আজ আমি ঠিক ওই বলে আশীর্বাদ করব, যেন তুমিও ভবিষ্যতে সুখী হতে পারো।
ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, ছোটর আশীর্বাদ খাটে না। উল্টো ফল হয়।
ভারতী বলিল, মিছে কথা। তা ছাড়া আমি শুধু ছোট নয়, আর একদিক দিয়ে তোমার বড়। যাবার আগে তুমি সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে সুমিত্রাদিদির সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়ে রেখে যেতে চাও।
সে আমি হতে দেব না। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিতে লাগিল, তুমি বলবে সুমিত্রাকে ত তুমি ভালবাস না। নাই বাসলে। তোমাদের পুরুষমানুষের ভালবাসার কতটুকু দাম দাদা, যা আজ আছে কাল নেই? অপূর্ববাবুও আমাকে ভালবাসতে পারেন নি, কিন্তু আমি ত পেরেছি। আমার পারাই যা-কিছু সব। বোলতার মধু সঞ্চয়ের শক্তি নেই বলে ঝগড়া করতে যাবো কার সঙ্গে? কিন্তু আজ তোমাকে বলচি দাদা, এই বিশ্ব-বিধানের প্রভু যদি কেউ থাকেন, নারী-হৃদয়ের এত বড় প্রেমের ঋণ শুধতে তাঁকে আমার হাতে এনে অপূর্ববাবুকে সঁপে দিতে হবেই হবে। এই বলিয়া ভারতী কিছু একটা উত্তরের আশায় ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া কহিল, দাদা, তুমি মনে মনে হাসচো?
কৈ, না!
নিশ্চয়। নইলে তুমি জবাব দিলে না কেন? এই বলিয়া সে অন্ধকারে যতদূর পারা যায় সব্যসাচীর মুখের প্রতি তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।
ডাক্তার হেঁট হইয়া তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া এইবার হাসিলেন, বলিলেন, জবাব দেবার কিছু ছিল না ভারতী। তোমার বিশ্ব-বিধানের প্রভুটিকে যদি এই জবরদস্তিই মেনে চলতে হতো, তোমার সুমিত্রাদিদির কি হতো জানো? ব্রজেন্দ্রের হাতেই নিজেকে সর্বপ্রকারে সঁপে দিয়ে তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে হতো।
ভারতী বিশেষ চমকিত হইল না। আজিকার ব্যাপারের পরে এই সন্দেহই তাহার মনে ঘনীভূত হইয়া উঠিতেছিল, জিজ্ঞাসা করিল, ব্রজেন্দ্র কি তাঁকে তোমার চেয়ে,—আমি বলচি, এত বেশী ভালবাসেন?
ডাক্তার সহসা উত্তর দিতে পারিলেন না। তারপর কহিলেন, বলা একটু কঠিন। এ যদি নিছক একটা আকর্ষণই হয় ত মানুষের সমাজে তার তুলনা হয় না। লজ্জা নেই, শরম নেই,সম্ভ্রম নেই,—হিতাহিতবোধলুপ্ত জানোয়ারের উন্মত্ত আবেগ যে চোখে না দেখেচে সে তার মনের পরিচয়ই পাবে না। ভারতী, তোমার দাদার এই হাত-দুটো বলে কোন বস্তু যদি সংসারে না থাকতো, সুমিত্রার আত্মহত্যা ছাড়া বোধ হয় আর কোন পথ খোলা থাকত না। তোমার বিশ্ব-বিধানের প্রভুটিও এতদিন এদের খাতির না করে পারেন নি। এই বলিয়া তিনি ভারতীর আনত মাথার পরে সেই হাত-দুটি রাখিয়া ধীরে ধীরে চাপড়াইতে লাগিলেন।
এতক্ষণে ভারতী শঙ্কায় ত্রস্ত হইয়া উঠিল, বলিল, দাদা, এত জেনেও তুমি এরই হাতে সুমিত্রাকে ফেলে রেখে যেতে চাচ্চো? এতবড় নিষ্ঠুর তুমি হতে পারো, আমি ভাবতেই পারিনে।
ডাক্তারকহিলেন, তাই ত আজ যাবার আগে সমস্ত চুকিয়ে দিয়ে যেতে চেয়েছিলাম,—কিন্তু সুমিত্রাই ত হতে দিলে না।
ভারতী সভয়ে প্রশ্ন করিল, হতে দিলে না কিরকম? তুমি কি সত্যিই ব্রজেন্দ্রকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে নাকি?
ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হাঁ, সত্যিই চেয়েছিলাম ! ইতিমধ্যে পুলিশের লোকে যদি না তাকে জেলে পাঠায় ত ফিরে এসে আর একদিন আমাকেই এ কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
এতক্ষণ পর্যন্ত ভারতী তাঁহার ক্রোড়ের উপর হেলান দিয়া বসিয়া ছিল, এই কথার পরে উঠিয়া বসিয়া একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিল। সে যে অন্তরের মধ্যে একটা কঠিন আঘাত পাইল ডাক্তার তাহা বুঝিলেন, কিন্তু কোন কথা না কহিয়া পর-পারের জন্য প্রস্তুত হইয়া পার্শ্বে রক্ষিত দাঁড়-দুটা হাতে টানিয়া লইলেন।
অনেকক্ষণ পরে ভারতী আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা দাদা, আমি যদি তোমার সুমিত্রা হতাম, এমনি করে কি আমাকেও ফেলে যেতে পারতে?
ডাক্তার হাসিলেন, বলিলেন, কিন্তু তুমি ত সুমিত্রা নও, তুমি ভারতী। তাই তোমাকে আমি ফেলে যাবো না, কাজের জন্যে রেখে যাবো।
ভারতী ব্যগ্র হইয়া কহিল, রক্ষে কর দাদা, তোমাদের এই-সব খুনোখুনি রক্তারক্তির মধ্যে আমি আর নেই। তোমার গুপ্ত-সমিতির কাজ আমাকে দিয়ে আর হবে না।
ডাক্তার বলিলেন, তার মানে এঁদের মত তুমিও আমাকে ত্যাগ করে যেতে চাচ্চো?
এই উক্তি শুনিয়া ভারতী ক্ষোভে ব্যাকুল হইয়া উঠিল, কহিল, এতবড় অন্যায় কথা তুমি আমাকে বলতে পারো দাদা? তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো, কিন্তু, আমি নিজে থেকে তোমাকে ত্যাগ করে গেছি, এ কথা মনে হলে কি একটা দিনের জন্যেও বাঁচতে পারি তুমি ভাবো? আমি তোমারই কাজ করে যাবো, যতদিন না তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে ছুটি দাও। একটুখানি থামিয়া কহিল, কিন্তু আমি ত জানি, মানুষ খুন করে বেড়ানোই তোমার আসল কাজ নয়, তোমার কাজ মানুষকে মানুষের মত করে বাঁচানো। তোমার সেই কাজেই আমি লেগে থাকবো, এবং সেই ভেবেই ত তোমাদের মধ্যে আমি এসেছিলাম।