ভারতী হাসিয়া কহিল, খালাস কোনদিন পাবেও না দাদা।
ডাক্তার কহিতে লাগিলেন, ক্রমশঃ তাঁদের দলের লোক খবর পেয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো, বন্ধু ক্রুগারও দেখতে পেলাম সৌন্দর্যে চঞ্চল হয়ে উঠছেন, অতএব তাঁর জিম্মাতে রেখেই একদিন চুপি চুপি সুমিত্রা ছেড়ে সরে পড়লাম।
ভারতী আশ্চর্য হইয়া বলিল, এদের মাঝে তাঁকে একলা ফেলে রেখে? উঃ—তুমি কি নিষ্ঠুর দাদা!
ডাক্তার বলিলেন, হাঁ অনেকটা অপূর্বর মত। আবার বছর-খানেক কেটে গেল। তখন সেলিবিস দ্বীপের ম্যাকেসার শহরে একটি ছোট্ট অখ্যাত হোটেলে বাস করছিলাম, একদিন সন্ধ্যার সময় ঘরে ঢুকে দেখি সুমিত্রা বসে। তার পরনে হিন্দু মেয়েদের মত তসরের শাড়ি, আর এই প্রথম আজ আমাকে সে হিন্দু মেয়ের মতই হেঁট হয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। বললে, আমি সমস্ত ছেড়ে চলে এসেছি, সমস্ত অতীত মুছে ফেলে দিয়েছি, আমাকে তোমার কাজে ভর্তি করে নাও, আমার চেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর তুমি আর পাবে না।
ভারতী নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া প্রশ্ন করিল, তার পরে?
ডাক্তার কহিলেন, পরের ঘটনা শুধু এইটুকুই বলতে পারি, ভারতী, সুমিত্রার বিরুদ্ধে নালিশ করবার আমি আজও কোন হেতু পাইনি। যে একুশ বছরের সমস্ত সংস্কার একদিনে মুছে ফেলে আসতে পারে, তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু, বড় নিষ্ঠুর।
ভারতী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার কেবলই ইচ্ছা করিতে লাগিল জিজ্ঞাসা করে, হোক নিষ্ঠুর, কিন্তু, তাঁকে তুমি কতখানি ভালবাসো? কিন্তু, লজ্জায় এ কথা সে কিছুতেই মুখ দিয়া উচ্চারণ করিতে পারিল না। অথচ ওই আশ্চর্য রমণীর গোপন অন্তরের অনেক ইতিহাসেরই আজ সে সন্ধান পাইল। তাঁহার নির্মম মৌনতা, কঠোর ঔদাসীন্য—কিছুরই অর্থ বুঝিতে যেন আর তাহার বাকী রহিল না।
হঠাৎ একটা অতর্কিত দীর্ঘশ্বাস ডাক্তারের মুখ দিয়া বাহির হইয়া পড়ায় মুহূর্তকালের জন্য যেন তিনি লজ্জায় ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। কিন্তু, ওই মুহূর্তের জন্যই। সুদীর্ঘ সাধনায় দেহ ও মনের প্রতিবিন্দুটির উপরেই অসামান্য অধিকার এতদিন তিনি বৃথায় অর্জন করেন নাই। পরক্ষণেই তাঁহার শান্তকণ্ঠ ও সহজ-হাস্যমুখ ফিরিয়া আসিল, বলিলেন, তারপরে সুমিত্রাকে নিয়ে আমাকে ক্যান্টনে চলে আসতে হ’ল।
ভারতী হাসি গোপন করিয়া ভালমানুষের মত মুখ করিয়া কহিল, চলে না-ই আসতে দাদা, কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল বল? আমরা ত কেউ দিইনি!
ডাক্তার হাসিমুখে ক্ষণকাল নীরব হইয়া থাকিয়া বলিলেন, মাথার দিব্যি যে ছিল না তা নয়, কিন্তু ভেবেছিলাম সে কথা আর কেউ জানবে না, কিন্তু, তোমাদের দোষ এই যে শেষ পর্যন্ত না শুনলে আর কৌতূহল মেটে না। আবার না বললে এমন-সব কথা অনুমান করতে থাকবে যে তার চেয়ে বরঞ্চ বলাই ভাল।
ভারতী কহিল, আমিও ত তাই বলচি দাদা। ঐটুকু তুমি বলে ফেল।
ডাক্তার কহিলেন, ব্যাপারটা এই যে সুমিত্রা আমার হোটেলেই একটা দোতলার ঘর ভাড়া নিলে। আমি অনেক নিষেধ করলাম, কিন্তু, কিছুতেই শুনলে না। যখন বললাম, আমাকে তাহলে অন্যত্র যেতে হবে, তখন তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। বললে, আমাকে আপনি আশ্রয় দিন। পরদিনই ব্যাপারটা বোঝা গেল। সেই দাউদের দল দেখা দিলেন। জন-দশেক লোক, একজন অর্ধেক আরবি অর্ধেক নিগ্রো, ছোটখাটো একটা হাতীর মত, অনায়াসে সুমিত্রাকে স্ত্রী বলে দাবী করে বসলো।
ভারতী কহিল, আবার তোমারই সাক্ষাতে! তোমাদের দুজনের বোধ করি খুব ঝগড়া বেধে গেল?
ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হাঁ। সুমিত্রা অস্বীকার করে বারবার বলতে লাগলো সমস্ত মিথ্যা, সমস্তই একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র! অর্থাৎ, তারা তাকে চোরাই আফিং বেচার কাজে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। প্রশান্ত মহাসাগরের সমস্ত দ্বীপগুলোতেই এদের ঘাঁটি আছে,—এদের একটা প্রকাণ্ড দুর্বৃত্তের দল। এরা না পারে এমন কাজ নেই। বুঝলাম সুমিত্রা কেন আমার কাছ থেকে যেতে চায়নি, এবং তার চেয়েও বেশী বুঝলাম যে এ সমস্যার সহজে মীমাংসা হবে না। তাদের কিন্তু বিলম্ব সয় না, সদ্যসদ্যই একটা রফা করে সুমিত্রাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। বাধা দিলাম, পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেব ভয় দেখালাম, তারা চলে গেল, কিন্তু রীতিমত শাসিয়ে গেল যে তাদের হাত থেকে আজও কেউ নিস্তার পায়নি। কথাটা নেহাত তারা মিথ্যে বলে যায়নি।
ভারতী শঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া কহিল, তার পরে?
ডাক্তার কহিলেন, রাত্রিটা সাবধান হয়ে রইলাম। তারা যে সদলবলে ফিরে এসে আক্রমণ করবে তা জানতাম।
ভারতী ব্যগ্র হইয়া কহিল, তখনি তোমরা পালিয়ে গেলে না কেন? পুলিশে খবর দিলে না কেন? ডচ্ গবর্নমেন্টের পুলিশ-পাহারা বলে কি কিছু নেই নাকি?
ডাক্তার কহিলেন, না থাকার মধ্যেই। তা ছাড়া থানা-পুলিশ করা আমার নিজেরও খুব নিরাপদ নয়। যাই হোক, রাত্রিটা কিন্তু নিরাপদেই কাটলো। এখানে সমুদ্রের কিনারা বয়ে যাবার অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের নৌকা পাওয়া যায়, পরদিন সকালেই একটা ঠিক করে এলাম, কিন্তু সুমিত্রার হল জ্বর,—সে উঠতে পারলে না। অনেক রাত্রে দোর খোলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম হোটেলওয়ালা কপাট খুলে দিয়েচে, এবং জন দশ-বারো লোক বাড়িতে ঢুকচে। তাদের ইচ্ছে ছিল আমার দরজাটা কোনমতে আটকে রেখে তারা পাশের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে সুমিত্রার ঘরে গিয়ে ঢোকে।