ভারতী সভয়ে কহিল, কি হল তার পরে?
ডাক্তার কহিলেন, লোকটা বিবেচক ছিল, ভোর হবার পূর্বেই চোখ বুজলে। তাই সে-যাত্রায় নীলকান্তকে নড়াতে পারলাম।
ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, সিঙ্গাপুরে যোশীর ফাঁসি হয়। পল্টনের সিপাইদের নাম বলে দিলে ফাঁসিটা তার মাপ হতো,—গবর্নমেন্ট থেকে অনেক প্রকার চেষ্টাই হয়েছিল, কিন্তু যোশী সেই যে ঘাড় নেড়ে বললে আমি জানিনে, তার আর বদল হল না। অতএব, রাজার আইনে তার ফাঁসি হল। অথচ, যাদের জন্য সে প্রাণ দিলে, তাদের সে ভাল করে চিনতও না। এখনও এই-সব ছেলে এদেশেই জন্মায় ভারতী, তা নইলে বাকী জীবনটা তোমার আঁচলের তলায় লুকিয়ে থাকতেই হয়ত রাজী হয়ে পড়তাম।
প্রত্যুত্তরে ভারতী শুধু দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল। ডাক্তার কহিলেন, নরহত্যা আমার ব্রত নয়, ভাই, তোমাকে সত্যই বলচি, ও আমি চাইনে।
চাইতে না পারো, কিন্তু প্রয়োজন হলে?
প্রয়োজন হলে? কিন্তু, ব্রজেন্দ্রের প্রয়োজন এবং সব্যসাচীর প্রয়োজন ত এক নয় ভারতী।
ভারতী বলিল, সে আমি জানি। আমি তোমার প্রয়োজনের কথাই জিজ্ঞাসা করচি দাদা।
প্রশ্ন শুনিয়া ডাক্তার ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিলেন। মনে হইল যেন উওর দিতে তিনি দ্বিধা বোধ করিতেছেন। তাহার পরে কতকটা যেন অন্যমনস্কের মত ধীরে ধীরে বলিলেন, কে জানে কবে আমার সেই পরম প্রয়োজনের দিন আসবে। কিন্তু, থাক, ভারতী, এ তুমি জানতে চেয়ো না। তার চেহারা তুমি কল্পনাতেও সইতে পারবে না, বোন।
ভারতী এ ইঙ্গিত বুঝিতে পারিয়া মনে মনে শিহরিয়া উঠিল, কহিল, এ ছাড়া কি আর পথ নেই?
না।
তাঁহার মুখের এই সংশয়লেশহীন অকুণ্ঠিত উওর শুনিয়া ভারতী হতবুদ্ধি হইয়া গেল, কিন্তু এই ভয়ঙ্কর ‘না’ সে সত্যই সহ্য করিতে পারিল না। ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, এ ছাড়া আর পথ নেই, এমন কিন্তু হতেই পারে না দাদা।
ডাক্তার মুচকিয়া হাসিয়া কহিলেন, না, পথ আছে বৈ কি! আপনাকে ভোলাবার অনেক রাস্তা খোলা আছে, ভারতী, কিন্তু সত্যে পৌঁছাবার আর দ্বিতীয় পথ নেই।
ভারতী স্বীকার করিতে পারিল না। শান্ত, মৃদুকণ্ঠে কহিল, দাদা, তুমি অশেষ জ্ঞানী। এই একটিমাত্র লক্ষ্য স্থির রেখে তুমি পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েচ, তোমার অভিজ্ঞতার অন্ত নেই। তোমার মত এতবড় মানুষ আমি আর কখনো দেখিনি। আমার মনে হয়, কেবল তোমার সেবা করেই আমি সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। তোমার সঙ্গে তর্ক সাজে না, কিন্তু বল, আমার অপরাধ নেবে না?
ডাক্তার হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, কি বিপদ! অপরাধ নেব কিসের জন্যে?
ভারতী তেমনি স্নিগ্ধ সবিনয়ে কহিতে লাগিল, আমি ক্রীশ্চান, শিশুকাল থেকে ইংরাজকেই আত্মীয় জেনে, বন্ধু জেনে বড় হয়ে উঠেছি, আজ তাদের প্রতি মন ঘৃণায় পূর্ণ করে তুলতে আমার ভারী কষ্ট হয়। কিন্তু তুমি ছাড়া এ কথা আমি কারও সুমুখে বলতে পারিনে। অথচ, তোমাদের মতই আমি ভারতবর্ষের,—বাঙলা দেশের মেয়ে। আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না।
তাহার কথা শুনিয়া ডাক্তার আশ্চর্য হইলেন।
সস্নেহে ডান হাতখানি তাহার মাথার উপরে রাখিয়া কহিলেন, এ আশঙ্কা কেন ভারতী? তুমি ত জানো তোমাকে আমি কত স্নেহ, কত বিশ্বাস করি।
ভারতী বলিল, জানি। আর তুমিও কি আমার ঠিক এই কথাই জান না দাদা? তোমার ভয় নেই, ভয় তোমাকে দেখানো যায় না, শুধু সেইজন্যেই কেবল তোমাকে বলতে পারিনি, এ বাড়িতে আর তুমি এসো না। কিন্তু এও জানি, আজকে রাত্রির পরে আর কখনো,—না না, তা নয়, হয়ত, অনেকদিন আর দেখা হবে না। সেদিন যখন তুমি সমস্ত ইংরাজ জাতির বিরুদ্ধে ভীষণ অভিযোগ করলে তখন প্রতিবাদ আমি করিনি, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে নিরন্তর এই প্রার্থনাই করেচি, এতবড় বিদ্বেষ যেন না তোমার অন্তরের সমস্ত সত্য আচ্ছন্ন করে রাখে। দাদা, তবুও আমি তোমাদেরই।
ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, হাঁ আমি জানি, তুমি আমাদেরই।
তা হলে এ পথ তুমি ছাড়।
ডাক্তার চমকিয়া উঠিলেন, কোন্ পথ?
বিপ্লবীদের এই নির্মম পথ।
কেন ছাড়তে বল?
ভারতী কহিল, তোমাকে মরতে দিতে আমি পারব না। সুমিত্রা পারে, কিন্তু আমি পারিনে। ভারতের মুক্তি আমরা চাই—অকপটে, অসঙ্কোচে, মুক্তকণ্ঠে চাই। দুর্বল, পীড়িত, ক্ষুধিত ভারতবাসীর অন্নবস্ত্র চাই। মনুষ্য-জন্ম নিয়ে মানুষের একমাত্র কাম্য স্বাধীনতার আনন্দ উপলব্ধি করতে চাই। ভগবানের এতবড় সত্যে উপস্থিত হবার এই নিষ্ঠুর পথ ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই এ আমি কোন মতেই ভাবতে পারিনে। পৃথিবী ঘুরে তুমি শুধু এই পথের খবরটাই জেনে এসেছ, সৃষ্টির দিন থেকে স্বাধীনতার তীর্থযাত্রী শত-সহস্র লোকের পায়ে পায়ে এই পথের চিহ্নটাই হয়ত তোমার চোখে স্পষ্ট হয়ে পড়েচে, কিন্তু বিশ্বমানবের একান্ত শুভবুদ্ধি, তার অনন্ত বুদ্ধির ধারা কি এমনিই নিঃশেষ হয়ে গেছে যে এই রক্তরেখা ছাড়া আর কোন পথের সন্ধানই কোন দিন তার চোখে পড়বে না? এমন বিধান কিছুতেই সত্য হতে পারে না। দাদা, মনুষ্যত্বের এতবড় পরিপূর্ণতা তুমি ছাড়া আর কোথাও আমি দেখিনি,—নিষ্ঠুরতার এই বারংবার চলা-পথে তুমি আর চলো না। দুয়ার হয়ত আজও রুদ্ধ আছে, তাই তুমি আমাদের জন্যে খুলে দাও—এ জগতের সবাইকে ভালবেসে আমরা তোমাকে অনুসরণ করে চলি।
ডাক্তার ম্লানমুখে একটুখানি হাসিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তারপর ভারতীর মাথার পরে হাত রাখিয়া বার-দুই ধীরে ধীরে চাপড়াইয়া কহিলেন, আমার আর সময় নেই ভাই, আমি চললাম।