ইহারই মুখোমুখি বামদিকের রুদ্ধদ্বারটা দেখাইয়া অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, এটাতে কে থাকে ?
দরোয়ান কহিল, কোই এক চীনা-সাহেব রহ্তেঁহে শুনা।
অপূর্ব ঠিক তাহার মাথার উপরে তেতলায় কে থাকে প্রশ্ন করায় সে কহিল, এক কালা সাহেব ত রহ্তেঁহে দেখা। কোই মান্দ্রাজ-বালে হোয়েঙ্গে জরুর!
অপূর্ব চুপ করিয়া রহিল। এই একমাত্র আনাগোনার পথে উপরে এবং পার্শ্বে এই দুটি একান্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর পরিচয়ে তাহার মুখ দিয়া কেবল দীর্ঘশ্বাস পড়িল। নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া তাহার আরও মন খারাপ হইয়া গেল। কাঠের বেড়া-দেওয়া পাশাপাশি ছোট-বড় তিনটি কুঠরী। একটিতে কল, স্নানের ঘর, রান্নার জায়গা প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় যাহা কিছু সমস্তই,—মাঝেরটি এই অন্ধকার সিঁড়ির ঘর, গৌরবে বৈঠকখানা বলা চলে, এবং সর্বশেষে রাস্তার ধারের কক্ষটি, অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার এবং আলোকিত,—এইটি শয়ন-মন্দির। আফিসের খরচায় এই ঘরটিকেই খাট, টেবিল এবং গুটিকয়েক চেয়ার দিয়া সাজানো হইয়াছে। পথের উপর ছোট একটুখানি বারান্দা আছে, সময় কাটানো অসম্ভব হইলে এখানে দাঁড়াইয়া লোক-চলাচল দেখা যায়। ঘরে হাওয়া নাই, আলো নাই, একটার মধ্যে দিয়া আর একটায় যাইতে হয়,—ইহার সমস্তই কাঠের,—দেয়াল কাঠের, মেঝে কাঠের, ছাত কাঠের, সিঁড়ি কাঠের, আগুনের কথা মনে হইলে সন্দেহ হয় এতবড় সর্বাঙ্গসুন্দর জতুগৃহ বোধ করি রাজা দুর্যোধনও তাঁর পাণ্ডবভায়াদের জন্য তৈরি করিয়া উঠিতে পারেন নাই। ইহারই অভ্যন্তরে এই সুদূর প্রবাসে ঘরবাড়ি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ছাড়িয়া, বৌদিদিদের ছাড়িয়া, মাকে ছাড়িয়া থাকিতে হইবে স্মরণ করিয়া মুহূর্তের দুর্বলতায় তাহার চোখে জল আসিতে চাহিল। সামলাইয়া লইয়া সে খানিকক্ষণ এঘর-ওঘর করিয়া একটা জিনিস দেখিয়া কিছু আশ্বস্ত হইল যে কলে তখনও জল আছে, স্নান ও রান্না দুই-ই হইতে পারে। দরোয়ান সাহস দিয়া জানাইল, অপব্যয় না করিলে এ শহরে জলের অভাব হয় না, যেহেতু প্রত্যেক দুই ঘর ভাড়াটিয়ার জন্য এ বাড়িতে একটা করিয়া বড় রকমের জলের চৌবাচ্চা উপরে আছে, তাহা হইতে দিবারাত্রিই জল সরবরাহ হয়। ভরসা পাইয়া অপূর্ব পাচককে কহিল ঠাকুর, মা ত সমস্তই সঙ্গে দিয়েছেন, তুমি স্নান করে দুটি রাঁধবার উদ্যোগ কর, আমি ততক্ষণ দরোয়ানজীকে নিয়ে জিনিসপত্র কিছু কিছু গুছিয়ে ফেলি।
রসুই ঘরে কয়লা মজুত ছিল, কিন্তু বাঁধানো চুল্লী। নিকানো মুছানো তেমন হয় নাই, পরীক্ষা করিয়া কিছু কিছু কালির দাগ প্রকাশ পাইল। কে জানে এখানে কে ছিল, সে কোন জাত, কি রাঁধিয়াছে মনে করিয়া তাহার অত্যন্ত ঘৃণাবোধ হইল, ঠাকুরকে কহিল, এতে ত রাঁধা চল্বে না তেওয়ারী, অন্য বন্দোবস্ত করতে হবে। একটা তোলা-উনুন হলে বাইরের ঘরে বসে আজকের মতো দুটো চাল-ডাল ফুটিয়ে নেওয়া যেত, কিন্তু এ পোড়া দেশে কি তা মিলবে?
দরোয়ান জানাইল কোন অভাব নাই, মূল্য পাইলে সে দশ মিনিটের মধ্যে আনিয়া হাজির করিতে পারে। অতএব, সে টাকা লইয়া প্রস্থান করিল। ইতিমধ্যে তেওয়ারী রন্ধনের আয়োজন করিতে লাগিল, এবং অপূর্ব নিজে যথাযোগ্য স্থান মনোনীত করিয়া তোরঙ্গ, বাক্স প্রভৃতি টানাটানি করিয়া ঘর সাজাইতে নিযুক্ত হইল। কাঠের আলনায় জামাকাপড় সুট প্রভৃতি গুছাইয়া ফেলিল, বিছানা খুলিয়া খাটের উপর তাহা পরিপাটি করিয়া বিছাইয়া লইল, তোরঙ্গ হইতে একটা নূতন টেবিল-ক্লথ বাহির করিয়া টেবিলে পাতিয়া কিছু কিছু বই ও লিখিবার সরঞ্জাম সাজাইয়া রাখিল, এবং উত্তরে খোলা জানালার পাল্লা-দুটা আপ্রান্ত প্রসারিত করিয়া তাহার দুই কোণে দুটা কাগজ গুঁজিয়া দিয়া শোবার ঘরটাকে অধিকতর আলোকিত এবং নয়নরঞ্জন জ্ঞান করিয়া সদ্যরচিত শয্যায় চিত হইয়া পড়িয়া একটা নিঃশ্বাস মোচন করিল।
ক্ষণেক পরেই দরোয়ান লোহার চুল্লী কিনিয়া উপস্থিত করিলে তাহাতে আগুন দিয়া খিচুড়ি এবং যাহা-কিছু একটা ভাজাভুজি যত শীঘ্র সম্ভব প্রস্তুত করিয়া ফেলিতে আদেশ দিয়া অপূর্ব আর একদফা বিছানায় গড়াইয়া লইতে যাইতেছিলেন, হঠাৎ মনে পড়িল মা মাথার দিব্য দিয়া বলিয়া দিয়াছিলেন নামিয়াই একটা টেলিগ্রাফ করিয়া দিতে। অতএব, অবিলম্বে জামাটা গায়ে দিয়া প্রবাসের একমাত্র কর্ণধার দরোয়ানজীকে সঙ্গে করিয়া সে পোস্টআফিসের উদ্দেশে আর একবার বাহির হইয়া পড়িল, এবং তাহারই কথামত তেওয়ারী ঠাকুরকে আশ্বাস দিয়া গেল, ফিরিয়া আসিতে তাহার একঘণ্টার বেশি লাগিবে না, কিন্তু ইতিমধ্যে সমস্ত যেন প্রস্তুত হইয়া থাকে।
আজ কি একটা খ্রীষ্টান পর্বোপলক্ষে ছুটি ছিল। অপূর্ব পথের দুইধারে চাহিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইয়াই বুঝিল এই গলিটা দেশী ও বিদেশী মেমসাহেবদের পাড়া, এবং প্রত্যেক বাটীতেই বিলাতী উৎসবের কিছু কিছু চিহ্ন দেখা দিয়াছে। অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা দরোয়ানজী, এখানে আমাদের বাঙালী লোকও ত অনেক আছে শুনেচি, তাঁরা সব কোন্ পাড়ায় থাকেন?
প্রত্যুত্তরে সে জানাইল যে এখানে পাড়া বলিয়া কিছু নাই, যে যেখানে খুশি থাকে। তবে ‘অপসর লোগ্’ এই গলিটাকেই বেশী পছন্দ করে। অপূর্ব নিজেও একজন ‘অপসর লোগ্’, কারণ, সেও বড় চাকরি করিতেই এ দেশে আসিয়াছে, এবং আপনি গোঁড়া হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও কোন ধর্মের বিরুদ্ধে তাহার বিদ্বেষ ছিল না। তথাপি, এইভাবে আপনাকে উপরে নীচে দক্ষিণে বামে বাসায় ও বাসার বাহিরে চারিদিকেই খ্রীষ্টান প্রতিবেশী পরিবৃত দেখিয়া তাহার অত্যন্ত বিতৃষ্ণা বোধ হইল। জিজ্ঞাসা করিল, আর কি কোথাও বাসা পাওয়া যায় না দরোয়ান?