ডাক্তার মাংসখণ্ড মুখে পুরিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, অপূর্ব কি বললে শশী?
জবাব দিল ভারতী। কহিল, মা পীড়িত। চিকিৎসার প্রয়োজন, অতএব, টাকা চাই। ফিরে এসে লুকিয়ে গোলামি করলে কেউ জানতে পারবে না। ভয় তলওয়ারকরকে, ভয় ব্রজেন্দ্রকে। কিন্তু, কাকা পুলিশ কর্মচারী,—সে ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে গেছে দাদা। তুমি-আমিও বোধ হয় এখন আর বাদ যাবো না। ক্ষুদ্র! লোভী! সঙ্কীর্ণচিত্ত ভীরু! ছি!
ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন। ধীরে ধীরে বলিলেন, যথার্থ ভাল না বাসলে এমন প্রাণ খুলে যশোগান করা যায় না। কবি, এবার তোমার পালা। বাগে্দেবীকে স্মরণ করে তুমি এবার নবতারার গুণকীর্তন শুরু কর—আমার অবহিত হই!
ভারতী চকিত হইয়া কহিল, দাদা, তুমি আমাকে তিরস্কার করলে?
ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, তাই হবে হয়ত।
অভিমানে, ব্যথায়, ক্রোধে ভারতীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি কখখনো আমাকে বকতে পাবে না। ভেবেছ, সবাই শশীবাবুর মত মুখ বুজে সইতে পারে? তুমি কি জানো কি হয় মানুষের! উচ্ছ্বসিত বেদনায় কণ্ঠস্বর তাহার অবরুদ্ধ হইয়া আসিস, কহিল, তিনি ফিরে এসেছেন, এবার আমাকে তুমি কোথাও সরিয়া নিয়ে যাও দাদা,—আমি এ কোন্ দুর্ভাগার পায়ে আমার সমস্ত বিসর্জন দিয়ে বসে আছি! বলিতে বলিতেই মেঝের উপর মাথা রাখিয়া ভারতী ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া ফেলিল।
ডাক্তার স্মিতমুখে নীরবে আহার করিতে লাগিলেন। তাঁহার নির্বিকার ভাব দেখিয়া মনে হয় না যে, এই-সকল প্রণয়-উচ্ছ্বাস তাঁহাকে লেশমাত্র বিচলিত করিয়াছে। মিনিট পাঁচ-সাত পরে ভারতী উঠিয়া পাশের ঘরে গিয়া চোখ-মুখ ভাল করিয়া ধুইয়া মুছিয়া যথাস্থানে ফিরিয়া আসিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিল, দাদা, আর তোমাদের কিছু দেব?
ডাক্তার পকেটে হইতে রুমাল বাহির করিয়া বলিলেন, বামুনের ছেলে, কিছু ছাঁদা বেঁধে দাও, দিন-দুই যেন নিশ্চিন্ত হতে পারি।
ময়লা রুমালটা ফিরাইয়া দিয়া ভারতী খোঁজ করিয়া একখানা ধোয়া তোয়ালে বাহির করিল, এবং রকমারি খাদ্যবস্তুর একটি পুঁটলি বাঁধিয়া ডাক্তারের পাশে রাখিয়া দিয়া কহিল, এই ত হল বামুনের ছেলের ছাঁদা। আর ঐ টাকার ছোট্ট থলিটি?
ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, ওটি হল বামুনের ছেলের ভোজন-দক্ষিণা।
ভারতী বলিল, অর্থাৎ তুচ্ছ বিবাহ-ব্যাপারটা ছাড়া আসল দরকারী কাজগুলা সমস্তই নির্বিঘ্নে সমাধা হল।
অকস্মাৎ, হাঃ হাঃ করিয়া আরম্ভ করিয়াই ডাক্তার সজোরে হাত দিয়া নিজের মুখ চাপিয়া ধরিয়া হাসি থামাইলেন, গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কি যে ভগবানের অভিশাপ, ভারতী, হাসতে গেলেই মুখ দিয়ে আমার অট্টহাসি ছাড়া আর কিছু বার হতেই চায় না। অট্টকান্না কাঁদবার জন্যে তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে এলে আজ মুখ দেখানোই ভার হতো।
দাদা, আবার জ্বালাতন করচ?
জ্বালাতন করচি? আমি ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করচি।
ভারতী রাগ করিয়া আর একদিকে মুখ ফিরাইল, জবাব দিল না।
শশী বরাবর চুপ করিয়াই ছিল, এতক্ষণে কথা কহিল। অকস্মাৎ অতিশয় গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, আপনি যদি রাগ না করেন ত একটা কথা বলতে পারি। কেউ কেউ ভয়ানক সন্দেহ করে যে, আপনার সঙ্গেই একদিন ভারতীর বিবাহ হবে।
ডাক্তার মুহূর্তের জন্য চমকিত হইলেন, কিন্তু পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করিয়া উল্লাসভরে বলিয়া উঠিলেন, বল কি হে শশী, তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক, এমন সুদিন কি কখনো এতবড় দুর্ভাগার অদৃষ্টে হবে? এ যে স্বপ্নের অতীত, কবি!
শশী কহিল, কিন্তু অনেকে ত তাই ভাবেন।
ডাক্তার কহিলেন, হায়! হায়! অনেকে না ভেবে যদি একটিমাত্র লোক একটি পলকের জন্যও ভাবতেন!
ভারতী হাসিয়া ফেলিল। মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, দুর্ভাগার ভাগ্য ত একটি পলকেই বদলাতে পারে দাদা। তুমি হুকুম করে যদি বল, ভারতী, কালই আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে, আমি তোমার দিব্যি করে বলচি, বলব না যে আর একটা দিন সবুর কর।
ডাক্তার কহিলেন, কিন্তু অপূর্ব বেচারা যে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ফিরে এল, তার উপায়টা কি হবে?
ভারতী বলিল, তাঁর কনে-বৌ দেশে মজুদ আছে, তাঁর জন্যে তোমার দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তিনি বুক ফেটে মারা যাবেন না।
ডাক্তার গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাও, তোমার ভরসা ত কম নয় ভারতী!
ভারতী কহিল, তোমার হাতে পড়ব তার আর ভয়টা কিসের?
ডাক্তার শশীর প্রতি চাহিয়া বলিলেন, শুনে রেখো কবি! ভবিষ্যতে যদি অস্বীকার করি তোমাকে সাক্ষী দিতে হবে।
ভারতী বলিল, কাউকে সাক্ষী দিতে হবে না দাদা, আমি তোমার নাম নিয়ে এতবড় শপথ কখনো অস্বীকার করব না। শুধু তুমি স্বীকার করলেই হয়।
ডাক্তার কহিলেন, আচ্ছা দেখে নেবো তখন।
দেখো। এই বলিয়া ভারতী হাসিয়া কহিল, দাদা, আমিই বা কি আর সুমিত্রাই বা কি,—স্বর্গের ইন্দ্রদেব যদি উর্বশী মেনকা রম্ভাকে ডেকে বলতেন, সেকালের মুনি-ঋষিদের বদলে তোমাদের একালের সব্যসাচীর তপস্যা ভঙ্গ করতে হবে, ত আমি নিশ্চয় বলচি দাদা, মুখে কালি মেখে তাঁদের ফিরে যেতে হতো। রক্ত-মাংসের হৃদয় জয় করা যায়, কিন্তু পাথরের সঙ্গে কি লড়াই চলে! পরাধীনতার আগুনে পুড়ে সমস্ত বুক তোমার একেবারে পাষাণ হয়ে গেছে।
ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন। ভারতীর দুই চক্ষু শ্রদ্ধা ও স্নেহে অশ্রুসজল হইয়া উঠিল, কহিল, এ বিশ্বাস না থাকলে কি এমন করে তোমাকে আত্মসমর্পণ করতে পারতাম? আমি ত নবতারা নই। আমি জানি, আমার মস্ত ভুল হয়ে গেছে,—কিন্তু এ জীবনে সংশোধনের পথও আর নেই। একদিনের জন্যেও যাঁকে মনে মনে—