দুজনের মাঝখানে পড়িয়া সে যেন ম্লানমুখে ভয়ে ভয়ে বলিল, মা যে যেতে বারণ করচেন পিসিমা? তাহার বিপদ দেখিয়া ঊষা তাড়াতাড়ি বলিল, তোমাকে যেতে আমি বারণ করচি নে বাবা, আমি শুধু এই বলচি যে, তুমি চলে গেলে একলা বাড়িতে আমার বড় কষ্ট হবে।
ছেলেটি মুখে ইহার জবাব কিছু দিল না, কেবল অত্যন্ত কাছে ঘেঁষিয়া আসিয়া বিমাতার আঁচল ধরিয়া দাঁড়াইল। তাহার চুলের মধ্য দিয়া আঙ্গুল বুলাইতে বুলাইতে ঊষা হাসিয়া কহিল, ও যেতে চায় না ঠাকুরঝি।
লজ্জায় ও ক্রোধে বিভার মুখ কালো হইয়া উঠিল, এবং অতি-সভ্য সমাজের সহস্র উচ্চাঙ্গের শিক্ষা সত্ত্বেও সে আপনাকে সংবরণ করিতে পারিল না। কহিল, ওর কিন্তু যাওয়াই উচিত। এবং আমার বিশ্বাস, আপনি অন্যায় প্রশ্রয় না দিলে ও বাপের আজ্ঞা পালন করতো।
ঊষার ঠোঁটের কোণ দুটা শুধু একটুখানি কঠিন হইল, আর তাহার মুখের চেহারায় কোন ব্যতিক্রম লক্ষিত হইল না, কহিল, আমরা বুড়োমানুষেই নিজের উচিত ঠিক করে উঠতে পারিনে ভাই, সোমেন ত ছেলেমানুষ! ও বোঝেই বা কতটুকু! আর অন্যায় প্রশ্রয়ের কথা যদি তুললে ঠাকুরঝি, আমি অনেক ছেলে মানুষ করেচি, এসব আমি সামলাতে জানি। তোমাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
বিভা কঠোর হইয়া কহিল, দাদাকে তা হলে চিঠি লিখে দেব।
ঊষা কহিল, দিয়ো। লিখে দিয়ো যে, তাঁর এলাহাবাদের হুকুমের চেয়ে আমার কলকাতার হুকুমটাই আমি বড় মনে করি। কিন্তু দেখ ভাই বিভা, আমি তোমার সম্পর্কে এবং বয়সে দুই-ই বড়। এই নিয়ে আমার উপরে তুমি অভিমান করতে পারো না। এই বলিয়া সে পুনরায় একটুখানি হাসিয়া কহিল, আজ তুমি রাগ করে একবার বসলে না পর্যন্ত, কিন্তু আর একদিন তুমি নিজের ইচ্ছেয় বৌদিদির কাছে এসে বসবে, এ কথাও আজ তোমাকে বলে রাখলুম।
বিভা এ কথার কোন উত্তর দিল না, কহিল, আজ আমার সময় নেই—নমস্কার। এই বলিয়া সে দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল। গাড়িতে বসিয়া হঠাৎ সে উপরের দিকে চোখ তুলিতেই দেখিতে পাইল, বারান্দায় রেলিঙ ধরিয়া ঊষা সোমেনকে লইয়া তাহার প্রতি চাহিয়া মূর্তির মত স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।
চার
সাত দিনের ছুটি, কিন্তু প্রায় সপ্তাহ-দুই এলাহাবাদে কাটাইয়া হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা শৈলেশ্বর আসিয়া বাটীতে প্রবেশ করিল। সম্মুখের নীচে বারান্দায় বসিয়া সোমেন কতকগুলো কাঠি, রঙ-বেরঙের কাগজ, আঠা, দড়ি ইত্যাদি লইয়া অতিশয় ব্যস্ত ছিল, পিতার আগমন প্রথমে সে লক্ষ্য করে নাই, কিন্তু দেখিবামাত্র সংবর্ধনা করিল, এবং লজ্জিত আড়ষ্টভাবে পায়ের কাছে ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল। গুরুজনদিগকে প্রণাম করার ব্যাপারে এখনও সে পটুত্ব লাভ করে নাই, তাহার মুখ দেখিয়াই তাহা বুঝা গেল। খুব মন্দ না লাগিলেও শৈলেশ বিস্মিত হইল। কিন্তু ঐ কাগজ-কাঠি-আঠা প্রভৃতির প্রতি দৃষ্টি পড়িতেই বলিয়া উঠিল, ও-সব তোমার কি হচ্চে সোমেন?
সোমেন রহস্যটা এককথায় ফাঁস করিল না, বলিল, তুমি বল ত বাবা, ও কি?
বাবা বলিলেন, আমি কি করে জানব?
ছেলে হাততালি দিয়া মহা আনন্দে কহিল, আকাশ-প্রদীপ।
আকাশ-প্রদীপ! আকাশ-প্রদীপ কি হবে?
ইহার অদ্ভুত বিবরণ সোমেন আজ সকালেই শিখিয়াছে, কহিল, আজ সংক্রান্তি, কাল সন্ধ্যাবেলায় উই উঁচুতে বাঁশ বেঁধে টাঙ্গাতে হবে বাবা! মা বলেন, আমার ঠাকুরদ্দারা যাঁরা স্বর্গে আছেন, তাঁদের আলো দেখাতে হয়। তাঁরা আশীর্বাদ করেন।
শৈলেশের মেজাজ গরম হইয়াই ছিল, টান মারিয়া পা দিয়া সমস্ত ফেলিয়া ধমক দিয়া কহিল, আশীর্বাদ করেন! যত সমস্ত কুসংস্কার—যা পড় গে যা বলচি।
তাহার এত সাধের আকাশ-প্রদীপ ছত্রাকার হইয়া পড়ায় সোমেন কাঁদ-কাঁদ হইয়া উঠিল। উপরে কোথা হইতে অত্যন্ত মিষ্টকণ্ঠের ডাক আসিল, বাবা সোমেন, কাল বাজার থেকে আমি আরও ভাল একটা আকাশ-প্রদীপ তোমাকে কিনে আনিয়ে দেব, তুমি আমার কাছে এস।
সোমেন চোখ মুছিতে মুছিতে উপরে চলিয়া গেল। শৈলেশ কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া গম্ভীর বিরক্তমুখে তাহার পড়িবার ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। পরক্ষণেই ছোট্ট ঘণ্টার শব্দ হইল—টুন্ টুন্ টুন্ টুন্, কেহ সাড়া দিল না।
আবদুল!
আবদুল আসিল না।
গিরিধারী? গিরিধারী!
গিরিধারীর পরিবর্তে বাঙ্গালী চাকর গোকুল গিয়া পর্দার ফাঁক দিয়া মুখ বাড়াইয়া কহিল, আজ্ঞে—
শৈলেশ ভয়ানক ধমক দিয়া উঠিল, আজ্ঞে? ব্যাটারা মরেচিস?
গোকুল বলিল, আজ্ঞে না।
আজ্ঞে না? আবদুল কৈ?
গোকুল কহিল, মা তাকে ছুটি দিয়েছেন, সে বাড়ি গেছে।
ছুটি দিয়েচেন! বাড়ি গেছে! গিরিধারী কোথা গেল?
গোকুল জানাইল, সেও ছুটি পাইয়া দেশে চলিয়া গেছে।
শৈলেশ স্তম্ভিত হইয়া কহিল, বাড়িতে কি লোকজন কেউ আর নেই নাকি?
গোকুল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আজ্ঞে আর সবাই আছে।
তাই বা আছে কেন? যা দূর হ—
শৈলেশ্বর নিজেই তখন জুতা খুলিল, কোট খুলিয়া টেবিলের উপরেই জড় করিয়া রাখিল; আলনা হইতে কাপড় লইয়া ট্রাউজার খুলিয়া দূরের একটা চেয়ার লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিতে সেটা নীচে পড়িয়া লুটাইতে লাগিল; নেকটাই, কলার প্রভৃতি যেখানে সেখানে ফেলিয়া দিয়া নিজের চৌকিতে গিয়া বসিতেই ঠিক সম্মুখে টেবিলের উপর ছোট্ট একটি খাতা তাহার চোখে পড়িল—মলাটে লেখা, সংসার খরচের হিসাব। খুলিয়া দেখিল, মেয়েলি অক্ষরের চমৎকার স্পষ্ট লেখা। দৈনিক খরচের অঙ্ক—মাছ এত, শাক এত, চাল এত, ডাল এত,—হঠাৎ দ্বারের পর্দা সরানর শব্দে চকিত হইয়া দেখিল, কে একজন স্ত্রীলোক প্রবেশ করিতেছে। সে আর যেই হউক দাসী নয়, তাহা চক্ষের পলকে অনুভব করিয়া শৈলেশ হিসাবের খাতার মধ্যে একেবারে মগ্ন হইয়া গেল। যে আসিল সে তাহার পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, তুমি কি এত বেলায় আবার চা খাবে না কি? কিন্তু তাহলে আর ভাত খেতে পারবে না।