কার্পেটে হবে কি বন্ধু?
কি জানি মেমসাহেব, গান-বাজনা না কি হবে।
করবে কে?
সাহেবের সঙ্গে তিন-চারজন লোক এসেছে, করবে বোধ হয় তারাই।
দাদা এসেছেন?
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, শৈলেশ এসেছে?
বন্ধু ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, কাল রাত্রে সকলেই ফিরিয়া আসিয়াছেন। কার্পেট লইয়া সে প্রস্থান করিলে দুজনেই নতমুখে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিলেন। সেইদিনটা কোনমতে ধৈর্য ধরিয়া ক্ষেত্রমোহন পরদিন বিকালে বিভা ও উমাকে সঙ্গে করিয়া এ বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অভ্যাসমত নীচের লাইব্রেরি-ঘরে প্রবেশ করিতে গিয়া বাধা পড়িল। দরজার সেই ভারী পর্দাটা নাই, ভিতরের সমস্তই চোখে পড়িল।
একটা দিনেই বাড়ির চেহারা বদলাইয়া গেছে। বইয়ের আলমারিগুলো আছে, কিন্তু আর কোন আসবাব নাই। মেঝের উপর কম্বল ও তাহাতে ফর্সা জাজিম পাতিয়া জন-দুই লোক নধর পরিপুষ্ট-দেহের সর্বত্র হরিনামের ছাপ মারিয়া, গলায় মোটা মোটা তুলসীর মালা পরিয়া বসিয়া আছে, হঠাৎ সাহেব-মেম দেখিয়া সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। ইহাদের বিশ্রামে বিঘ্ন না ঘটাইয়া তিনজনে উপরে যাইতেছিলেন, উড়িয়া পাচক-ব্রাহ্মণ নিষেধ করিয়া কহিল, উপরের ঘরে গোঁসাইনি আছেন।
গোঁসাইনিটা কে?
পাচক-ঠাকুর চুপ করিয়া রহিল।
সাহেব কোথায়?
উত্তরে সে উপরে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া দেখাইলে ক্ষেত্রমোহন সেইখানেই দাঁড়াইয়া শৈলেশ, শৈলেশ করিয়া চেঁচাইতে লাগিলেন। ছুটিয়া আসিল সোমেন। হঠাৎ তাহার বেশভূষা ও চেহারা দেখিয়া বিভা কাঁদিয়া ফেলিল। পরনে সাদা থান, মাথায় মস্ত টিকি, গলায় তুলসীর মালা, সে দূর হইতে প্রণাম করিল, কিন্তু কাছে আসিল না। উমা ধরিতে যাইতেছিল, ক্ষেত্রমোহন ইঙ্গিতে নিষেধ করিয়া বলিলেন, থাক, অ-বেলায় আর ছুঁয়ে কাজ নেই। ও-বেচারাকে হয়ত আবার নাইয়ে দেবে। বাবা কোথায় সোমেন?
সোমেন কহিল, প্রভুপাদ শ্রীভাগবৎ পড়ছেন।
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, আমরা দাঁড়িয়ে রইলুম, শ্রীবাবাকে একবার খবরটা দাও।
তিনি খবর পেয়েচেন, আসচেন।
কয়েক মুহূর্ত পরে খড়ম পায়ে শৈলেশ নীচে আসিল। থান কাপড়, গায়ে জামা, মাথায় একটা সরুগোছের টিকি ছাড়া বাহিরের চেহারায় তাহার বিশেষ কোন পরিবর্তন নাই, কিন্তু ভিতরের দিকে যে অনেক বদল হইয়া গেছে তাহা চক্ষের পলকেই চোখে পড়ে। অত্যন্ত বিনীত ভাব, মৃদু কথা—উমা ও বিভা প্রণাম করিলে সে দূরে দাঁড়াইয়াই আশীর্বাদ করিল, স্পর্শ করিতে নিকটে আসিল না।
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, বাড়িতে একটু বসবার জায়গাও নেই নাকি হে?
শৈলেশ লজ্জিতভাবে কহিল, বাইরের ঘরটা নোংরা হয়ে আছে—পরিষ্কার করে নিতে হবে।
ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, তাহলে এখনকার মত আমরা বিদায় হই। সোমেনকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, এখন চললুম। আমাদের বোধ করি আর বড় একটা প্রয়োজন হবে না, তবু বলে যাই, বসবার জায়গা যদি কখনও একটা হয় ত খবর দিস্ বাবা! চল।
শৈলেশ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
গাড়িতে বিভা কাহারও সহিত একটা কথাও কহিল না, তাহার দু’চক্ষু বাহিয়া হু-হু করিয়া জল পড়িতে লাগিল। একটা কথা তাঁহারা নিঃসংশয়ে বুঝিয়া আসিলেন, ও-বাড়িতে তাঁহাদের আর স্থান নাই। দাদা যা-ই কেন না করুক, সোমেনকে সে জোর করিয়া কাড়িয়া আনিবে বলিয়া বিভা স্বামীর কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল। স্নেহের সেই দাম্ভিক উক্তি স্বামী-স্ত্রীর উভয়েই বার বার মনে পড়িল, কিন্তু নিদারুণ লজ্জায় ইহার আভাস পর্যন্তও কেহ উচ্চারণ করিতে পারিল না।
ইহার পর মাসাধিক কাল গত হইয়াছে। ইতিমধ্যে কথাটা আত্মীয় ও পরিচিত বন্ধু-সমাজে এমন আবর্তের সৃষ্টি করিয়াছে যে, লোকে সত্যের মধ্যেও আর যেন আবদ্ধ থাকিতে চাহে না।
মুখে মুখে অতিরঞ্জিত ও পল্লবিত হইয়া সমস্ত জিনিসটা এমন কুৎসিত আকার ধারণ করিয়াছে যে কোথাও যাওয়া-আসাও বিভার অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে, অথচ কোনদিকে কোন রাস্তাই কাহারও চোখে পড়িতেছে না। ক্ষেত্রমোহন জানিতেন, সংসারে অনেক উত্তেজনাই কালক্রমে ম্লান হইয়া আসে, ধৈর্য ধরিয়া স্থির হইয়া থাকাই তাহার উপায়, শুধু এই পরকালের লোভের ব্যবসাটাই একবার শুরু হইয়া গেলে আর সহজে থামিতে চাহে না। অনিশ্চিতের পথে এই অত্যন্ত সুনিশ্চিতের আশাই মানুষকে পাগল করিয়া যেন নিরন্তর ঠেলা দিয়া চালাইতে থাকে। ইহার উপরেও প্রচণ্ড বিভীষিকা ঊষা। বন্ধু ও শত্রুভাবে সর্বনাশের বনিয়াদ গড়িয়া গেছে সে-ই। কোনমতে একটা খবর পাইয়া যদি আসিয়া পড়ে ত অনিষ্টের বাকি কিছু আর থাকিবে না। কেবল বিভাই নয়, তাহার উল্লেখে উমার, এমনকি ক্ষেত্রমোহনেরও আজকাল গা জ্বলিতে থাকে। বাস্তবিক তাহাকে না আনিলে ত এ বালাই কোনদিনই ঘটার সম্ভাবনা ছিল না।
আজ রবিবারে সকালবেলা স্বামী-স্ত্রীতে বসিয়া এই আলোচনাই করিতেছিলেন। সেই অপমানিত হইয়া ফিরিয়া আসার দিন হইতে ইঁহারা সে-মুখোও আর হন নাই, কিন্তু সে বাড়ির খবর পাইতে বাকি থাকিত না। গুরুভ্রাতার দল অদ্যাবধি নড়িবার নামটি পর্যন্ত মুখে আনেন না এবং শ্রীগুরু ও গোঁসাই-ঠাকুরানী উপরের ঘরে তেমন কায়েম হইয়াই বিরাজ করিতেছেন। সকাল-সন্ধ্যায় নামকীর্তন অব্যাহত চলিয়াছে, ভোগাদির ব্যবস্থাও উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করিতেছে, এ-সকল সংবাদ বন্ধুজনের মুখে নিয়মিতভাবেই বিভার কানে পৌঁছে; কেবল অতিরিক্ত একটা কথা সম্প্রতি শোনা গিয়াছে যে, শ্রীধাম নবদ্বীপে একটা জায়গা লইয়া শৈলেশ গুরুদেবের আশ্রম তৈরি করার সঙ্কল্প করিয়াছে এবং এই হেতু অনেক টাকা ধার করিবার চেষ্টা করিয়া বেড়াইতেছে।