ক্ষেত্রমোহন মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না, সে বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু যাই কি করে? এবং গেলেই যে বিপদ কাটবে তারই বা ঠিকানা কি!
দুজনে বহুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন। অবশেষে দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করিয়া ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, শৈলেশের দ্বারা সমস্তই সম্ভব, মনের জোর বলে যে বস্তু, সে তার একেবারে নেই। মরুক গে সে, কিন্তু দুঃখ এইটুকু যে, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকেও সে বিগড়ে তুলচে। যেমন করে পারো এইখানে তোমার বাধা দেওয়া চাই।
বিভা বিষণ্ণ গম্ভীরমুখে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। সে কান্নাকাটি, অভিমান সমস্তই করিতে পারে, কিন্তু ঠেকাইবার সাধ্য তাহার নাই, তাহা সে মনে মনে জানিত। ক্ষেত্রমোহন অনেকক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিলেন, সন্দেহ আমার বরাবরই ছিল, কিন্তু একটি জিনিস আমি নিশ্চয় ধরেচি বিভা, ঊষাকে তোমার দাদা সত্যই ভালবেসেছিল। এত ভাল সে সোমেনের মাকে কোনদিন বাসেনি এসব হয়ত তারই প্রতিক্রিয়া।
বিভা রাগ করিল, কহিল, তাই, এমনি করে তাঁর মন পাওয়ার চেষ্টা করচেন? দেখ দাদা আমার দুর্বল হতে পারেন, কিন্তু ইতর নন। কারও জন্যেই এই সঙ সাজার ফন্দি মাথায় আসবে না।
এই প্রতিক্রিয়া বস্তুটা যে কি অদ্ভুত ব্যাপার বিভা তাহার কি জানে! শব্দটা শুধু ক্ষেত্রমোহন বইয়ে পড়িয়াছেন, তিনিও ইহার বিশেষ কিছু জানেন না, তাই স্ত্রীর ক্রোধের প্রত্যুত্তরে তিনি চুপ করিয়া রহিলেন। অন্ধকারে তর্কযুদ্ধ চালাইতে তাঁহার সাহস হইল না।
কিন্তু প্রতিক্রিয়া যাই হোক কাজের বেলায় বিভাই জয়ী হইল। স্বামীকে দিন-দুয়ের মধ্যেই কাজকর্ম ফেলিয়া এলাহাবাদ রওনা হইতে হইল। ফিরিয়া আসিয়া তিনি আনুপূর্বিক যাহা বর্ণনা করিলেন, তাহা যেমন হাস্যাস্পদ তেমনি অপ্রিয়। যোগেশবাবুর বাটীর কাছেই বাসা, কিন্তু শৈলেশের সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই, সে গুরুভাইদের সহিত শ্রীগুরুপাদপদ্ম-দর্শনে বৃন্দাবন গিয়াছে, দেখা হইয়াছে সোমেনের সঙ্গে। তাহার শাস্ত্রানুমোদিত ব্রহ্মচারীর বেশ, শাস্ত্রসঙ্গত আচার-বিচার। স্থানীয় একজন নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণ আসিয়া সকাল-সন্ধ্যায় বোধ করি ব্রহ্মবিদ্যা শিখাইয়া যান। এই বলিয়া ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, আমাকে দেখে সে বেচারার দু’চোখ ছলছল করতে লাগলো। তার চেহারা দেখে মনে হল যেন খাবার কষ্টটাই বেশি হয়েছে।
এই ছেলেটির প্রতি বিভার এক প্রকারের স্নেহ ছিল, তাহা অত্যন্ত বেশি না হইলেও বিদেশে দুঃখ পাইতেছে শুনিয়া সে সহিতে পারিল না। তাহার নিজের চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, কহিল, তাকে জোর করে নিয়ে এলে না কেন?
ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, ইচ্ছে যে হয়নি তা নয়, কিন্তু ভেবে দেখলুম, তাতে শেষ পর্যন্ত সুফল ফলবে না। ধর্মের ঝোঁকটাকেই আমি সবচেয়ে ভয় করি। শৈলেশ আমাদের উপর ঢের বেশি বেঁকে যেত।
বিভা চোখ মুছিয়া কহিল, এত ব্যাপার ঘটেছে জানলে আমি নিজেই তোমার সঙ্গে যেতুম।
সতর
চিঠি লেখালেখি একপ্রকার বন্ধ হইয়াই গিয়াছিল, তথাপি কলিকাতায় আত্মীয়-বন্ধু মহলে শৈলেশের অদ্ভুত কীর্তিকথা প্রচারিত হইতে বাধে নাই। হয়ত বা স্থানে স্থানে বিবরণ একটু ঘোরালো হইয়াই রটিয়াছিল। ভবানীপুরে এ সংবাদ যে গোপন ছিল না, তাহা বলাই বাহুল্য। লজ্জায় বিভা মুখ দেখাইতে পারিত না, শুধু স্বামীর কাছে সে দম্ভ করিয়া বলিত, দাদা আগে ফিরে আসুন, আমার সুমুখে কি করে এসব করেন আমি দেখবো।
ক্ষেত্রমোহন চুপ করিয়া থাকিতেন—বিভার দ্বারা বিশেষ কিছু যে হইবে তাহা বিশ্বাস করিতেন না, কিন্তু সমাজের সমবেত মর্যা ল প্রেশারের প্রতি তাঁহার আস্থা ছিল। দুর্বলচিত্ত শৈলেশ হয়ত তাহা বেশি দিন ঠেকাইতে পারিবে না, এ ভরসা তিনি করিতেন।
এদিকে শৈলেশ আরও মাস-চারেক ছুটি বাড়াইয়া লইয়াছিল, তাহাও শেষ হইতে আর মাস-দুই বাকি। চাকরি ছাড়িতে সে পারিবে না তাহা নিশ্চয়। গঙ্গাস্নান ও ফোঁটাতিলক যতই কেন না সে প্রয়াগে বসিয়া করুক, শ্রীগুরু ও গুরুভাইয়ের দল এ কুমতলব তাহাকে প্রাণ গেলেও দিবে না। তার পরে ফিরিয়া আসিলে একবার লড়াই করিয়া দেখিতে হইবে।
সেদিন চা খাইতে বসিয়া ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, এবার কিন্তু ঊষা বৌঠাকরুন এলে তাঁকে তাড়াতাড়ি ভাইকে ডাকিয়ে, আর বাপের বাড়ি পালাবার ফন্দি করতে হবে না। জপ-তপের মধ্যে দুজনের বনবে!
বিভার মুখ মলিন হইল, জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর আসার কথা তুমি শুনেচ নাকি!
না।
বিভা ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, পাড়াগাঁয়ে শুনেচি নানারকমের তুকতাক আছে, আচ্ছা, তুমি বিশ্বাস কর?
ক্ষেত্রমোহন হাসিয়া কহিলেন, না। যদিও বা থাকে এ-সব করবেন না।
কেন করবেন না?
ক্ষেত্রমোহন বলিল, বৌঠাকরুনের ওপর আমি খুশি নই, তাঁর প্রতি আমার সে শ্রদ্ধাও আর নেই, কিন্তু এই সব হীন কাজ যে তিনি করতেই পারেন না তা তোমাকে আমি দিব্যি করে বলতে পারি।
বিভা ঠিক বিশ্বাস করিল না। শুধু ধীরে ধীরে কহিল, যা ইচ্ছে হোক, কিন্তু ছেলেটাকে আমি কেড়ে আনবই, তোমাকেও আমি প্রতিজ্ঞা করে বললুম।
বেহারা আসিয়া খবর দিল, বন্ধু দুখানা বড় কার্পেট চাহিতে আসিয়াছে। বন্ধু শৈলেশের অনেক দিনের ভৃত্য, বিভা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, সে কার্পেট নিয়ে কি করবে? বলিতে বলিতে উভয়েই বাহিরে আসিতেই বন্ধু সেলাম করিয়া তাহার প্রার্থনা জানাইল।