সেই রাত্রে ছাপরা যাইবার পূর্বে ক্ষেত্রমোহন বিভাকে ডাকিয়া কহিলেন, আমার ফিরতে বোধ করি চার-পাঁচদিন দেরি হবে, ইতিমধ্যে ভবানীপুরে ওঁদের কারও সঙ্গে যদি দেখা হয়, বলো, শৈলেশকে সম্মত করাতে আমি পারব।
বিভা জিজ্ঞাসা করিল, বৌঠাকরুন তাহলে আর ফিরবেন না?
ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, না। যতই ভাবছি, মনে হচ্চে শৈলেশের চেয়ে তাঁর অপরাধই বেশি। তুমি ঠিক কথাই বলেচ। যে শিক্ষায় মানুষকে এত বড় সঙ্কীর্ণ এবং স্বার্থপর করে তোলে, সে শিক্ষার মূল্য এককালে যতই থাক এখন আর নেই। অন্ততঃ আমাদের মধ্যে তার আর পুনঃপ্রচলনের আবশ্যকতা নেই। তাই বটে। বৌঠাকরুনের আচার-বিচারের বিড়ম্বনাই ছিল, বস্তু কিছু ছিল না। থাকলে গৃহাশ্রয় ত্যাগ করতেন না। আচ্ছা চললুম, এই বলিয়া তিনি ঘর হইতে বাহির হইয়া মোটরে গিয়া উপবেশন করিলেন।
মফঃস্বলে মোকদ্দমা সারিয়া কলিকাতায় ফিরিতে তাঁহার পাঁচদিনের বদলে দিনদশেক বিলম্ব হইয়া গেল। বাটীতে পা দিয়া প্রথমেই দেখা মিলিল উমার। সে-ই খবর দিল যে, দিন-দুই পূর্বে মাস-ছয়েকের ছুটি লইয়া শৈলেশবাবু আবার এলাহাবাদে চলিয়া গিয়াছেন, এবং সোমেনকেও স্কুল ছাড়াইয়া এবার সঙ্গে লইয়া গিয়াছেন।
এমন হঠাৎ যে?
উমা কহিল, কি জানি! সোমেনকে নিতে এসেছিলেন, বললেন, শরীর ভাল নয়।
বিভার ঘরে প্রবেশ করিতেই তাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, শরীর ভাল না থাকবারই কথা, কিন্তু সারবার ব্যবস্থা ও নয়। আরও কি বলিতে যাইতেছিলেন কিন্তু উমা দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া চুপ করিয়া গেলেন।
নববিধান – ১৬-১৭
ষোল
আরও পাঁচটা জুনিয়র ব্যারিস্টারের যেভাবে দিন কাটে, ক্ষেত্রমোহনের দিনও তেমনি কাটিতে লাগিল। হাতে টাকার টান পড়িলে হিঁদুয়ানির ও সাবেক চালচলনের অশেষ প্রশংসা করেন, আবার অর্থাগম হইলেই চুপ করিয়া যান—যেমন চলিতেছিল, তেমনি চলে। শৈলেশের তিনি বাস্তবিক শুভাকাঙ্ক্ষী। তাহাকে চিনিতেন, তাহার মত দুর্বল প্রকৃতির মানুষকে দিয়ে প্রায় সব কাজই করানো যায়, এই মনে করিয়া তিনি ভবানীপুর এখনও হাতছাড়া করেন নাই। তাহাদের এই বলিয়া ভরসা দিতেন যে, পশ্চিম হইতে ঘুরিয়ে আসার যা বিলম্ব। বৌঠাকরুনকে তিনি এখনও প্রায় তেমনি স্নেহ করেন, তেমনি শ্রদ্ধাই প্রায় এখনও তাঁহার প্রতি আছে, কিন্তু ফিরিয়া আসিয়া আর কাজ নেই। যেখানে থাকুন সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন, ধর্মজীবনের তাঁহার উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটুক, কিন্তু শৈলেশের গৃহস্থালীর মধ্যে আর নয়। নিজের একটা ভুল এখন প্রায়ই মনে হয়, স্বামীকে ঊষা ভালবাসিতে পারে নাই, পারাও কখনও সম্ভব নয়। ছেলেবেলা হইতে কড়া রকমের আচার-বিচারের ভিতর দিয়ে ধাতটা তাহার কড়া হইয়াই গেছে, সুতরাং ইহকালের চেয়ে পরকালই তাহার বেশি আপনার। স্বামীকে ত্যাগ করিয়া যাওয়াও তাই এত সহজ হইয়াছে। তাঁহার নিজের মধ্যে যে স্বামী ছিল, ঊষার এই আচরণে সে যেমন ভীত, তেমনি ব্যথিত হইয়াছিল। তাঁহার মনে হইত, সোমেনকে যে সে এত সত্বর ভালবাসিয়াছিল, সেও কেবল সম্ভবপর হইয়াছিল তাহার কড়া কর্তব্যের দিক দিয়া। সত্যকার স্নেহ নয় বলিয়াই যাবার দিনটিতে তাহার কোথাও কোন টান লাগে নাই।
এমনিভাবেই যখন কলিকাতায় ইঁহাদের দিন কাটিতেছিল, তখন মাস-দুই পরে সহসা এলাহাবাদ হইতে খবর আসিল যে, সোমেনের এই কচি বয়সেই শৈলেশ তাহার পৈতা দিয়াছে, এবং নিজেও এক ভক্ত বৈষ্ণবের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছে। গঙ্গাস্নান একটা দিনের জন্যেও পিতাপুত্রের বাদ যাইবার জো নাই এবং মাছ-মাংস যে পাড়ায় আসে সে পথ দিয়া শৈলেশ হাঁটে না।
শুনিয়া উমা চুপিচুপি হাসিতে লাগিল। বিভা কহিল, তামাশাটি কে করলেন? যোগেশবাবু?
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, খবর যোগেশবাবুর কাছ থেকেই এসেচে সত্যি, কিন্তু তামাশা করবার মত ঘনিষ্ঠতা ত তাঁর সঙ্গে নেই।
বিভা কহিল, দাদার বন্ধু ত, দোষ কি? একটু থামিয়া বলিলেন, কেন জানো? বৌদিদির সমস্ত ব্যাপার দাদার কাছেই শুনেছেন এবং এত লোকের মাঝখানের তুমিই শুধু তাঁর গোঁড়ামির ভক্ত হয়ে উঠেছিলে—তাই এ রসিকতাটুকু তোমার ‘পরেই হয়েচে। সহাস্যে বলিতে লাগিল, কেস আরম্ভ করবার সময় মাঝে মাঝে বুদ্ধিটা যদি আমার কাছে নাও ত মোকদ্দমা বোধ হয় তোমাকে এত হারতে হয় না। উমা, আজ একটু চট্পট্ তৈরি হয়ে নাও, সাতটার মধ্যে পৌঁছতে না পারলে কিন্তু লাবণ্য রাগ করবে। তোমার দাদাটিকে আড়ালে ডেকে একটু বলে দিয়ো ভাই, ঠেকলে যেন এখন থেকে কন্সাল্ট করেন। পয়সা যারা দেয় তারা খুশি হবে।
উমা মুখ টিপিয়া হাসিয়া চলিয়া গেল। যোগেশবাবুর হঠাৎ ঠাট্টা করার হেতুটা যে বৌদিদি ঠিক অনুমান করিয়াছেন তাহা সে বুঝিল।
ইহার দিন পাঁচ-ছয় পরে, একখানা মস্ত চিঠি আনিয়া ক্ষেত্রমোহন স্ত্রীর সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া কহিলেন, যোগেশবাবুর বাবার লেখা। বয়স সত্তর-বাহাত্তর—চাক্ষুষ আলাপ নেই, চিঠিপত্রেই পরিচয়। লোক কেমন ঠিক জানিনে, তবে এটা ঠিক জানি যে, ঠাট্টার সুবাদ আমার সঙ্গে তাঁর নেই।
দীর্ঘ পত্র, বাঙ্গলায় লেখা। আদ্যোপান্ত বার-দুই নিঃশব্দে পড়িয়া বিভা মুখ তুলিয়া কহিল, ব্যাপার কি? তোমাকে ত একবার যেতে হয়।
কিন্তু আমার ত এক মিনিটের সময় নেই।
বিভা কহিল, সে বললে হবে না। এ বিপদে আমরা না গেলে আর যাবে কে? এ চিঠির অর্ধেকও যদি সত্যি হয়, সে যে ঘোরতর বিপদ তাতে ত আর একবিন্দু সন্দেহ নেই!