শৈলেশ মুখ তুলিয়া কহিল, চাচ্চেন? কেন, আমার পক্ষ থেকে কি তিনি বাধা পাবার আশঙ্কা করচেন?
অবিনাশ ছেলেমানুষ, সে হঠাৎ কি জবাব দিবে ভাবিয়া না পাইয়া শুধু কহিল, আজ্ঞে না।
দরজার বাহিরে চুড়ির শব্দ পাইয়া শৈলেশের মন আরও বাঁকিয়া গেল। বলিল, না, আমার তরফ থেকে তাঁর যাবার কোন নিষেধ নেই।
অবিনাশ নীরব হইয়া রহিল। শৈলেশ প্রশ্ন করিল, তোমার দাদার আসবার কথা শুনেছিলুম, তিনি এলেন না কেন?
অবিনাশ সঙ্কুচিতভাবে আস্তে আস্তে বলিল, তাঁর আমাকে পাঠাবারও তেমন ইচ্ছে ছিল না।
কেন?
অবিনাশ চুপ করিয়া রহিল।
শৈলেশ বলিল, তুমি ছেলেমানুষ, তোমাকে সব কথা বলাও যায় না, বলে লাভও নেই। তবে, তোমার দাদা যদি কখনো জানতে চান ত বলো যে, এ ব্যাপারে ঊষার দোষ নেই, দোষ কিংবা ভুল যদি কারও হয়ে থাকে ত সে আমার। তাঁকে আনতে পাঠানোই আমার উচিত হয়নি।
একটু স্থির থাকিয়া পুনশ্চ কহিতে লাগিল, মনে হত বাবা অন্যায় করে গেছেন। দীর্ঘকাল পরে অবস্থাবশে যখন সময় এল, ভাবলুম, এবার তার প্রতিকার হবে। তোমার দিদি এলেন বটে, কিন্তু এক দোষ শত দোষ হয়ে দেখা দিল।
ইহার আর উত্তর কি! অবিনাশ মৌন হইয়া রহিল, এমনি সময় সহসা অন্য দিকের দরজা ঠেলিয়া ঘরে ক্ষেত্রমোহন প্রবেশ করিলেন। শৈলেশ চাহিয়া দেখিল, কিন্তু থামিতে পারিল না। কঠিন বাক্যের স্বভাবই এই যে, সে নিজের ভারেই নিজে কঠিনতর হইয়া উঠিতে থাকে। ঊষা অন্তরালে দাঁড়াইয়া; অভ্রান্ত লক্ষ্যে তাহাকে নিরন্তর বিদ্ধ করিবার নির্দয় উত্তেজনায় জ্ঞানশূন্য হইয়া শৈলেশ বলিতে লাগিল, তোমার ভগিনীকে একদিন বিবাহ করেছিলুম সত্য, কিন্তু সহধর্মিনী তাঁকে কোনমতেই বলা চলে না। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, সমাজ, ধর্ম কিছুই এক নয়—জোর করে তাঁকে গৃহে রাখতে নিজের বাড়িটাকে যদি স্মৃতিশাস্ত্রের টোল বানিয়েও তুলি, কিন্তু আমার একমাত্র ছোটবোন দুঃখে ক্ষোভে পর হয়ে যায়, একটিমাত্র ছেলে কুশিক্ষায় কু-দৃষ্টান্তে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এ ত কোনক্রমেই আমি হতে দিতে পারিনে। তবে তাঁর কাছে আমি এই জন্যে কৃতজ্ঞ যে, মুখে ফুটে আমি যা বলতে পারছিলুম না, তিনি নিজে থেকে সেই দুরূহ কর্তব্যটাই আমার সম্পন্ন করে দিলেন।
ক্ষেত্রমোহন বিস্ময়ে বাক্শূন্য হইয়া চাহিয়া রহিলেন।
শৈলেশ লাজুক, দুর্বল স্বভাবের লোক, ভয়ঙ্কর কিছু উচ্চারণ করা তাহার একান্তই প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। কিন্তু উন্মাদের মত সে এ কি করিতেছে! ঊষার ছোটভাই লইতে আসিয়াছে এ সংবাদ তিনি ইতিপূর্বেই পাইয়াছিলেন, অতএব অপরিচিত লোকটি যে সে-ই, তাহাতে সন্দেহ নাই—তাহারই সম্মুখে এসব কি? ক্ষেত্রমোহন ব্যগ্র-অনুনয়ে হাত দুটি প্রায় জোড় করিয়াই বলিয়া উঠিলেন, দেখবেন, আপনার দিদিকে যেন এসব ঘুণাগ্রেও জানাবেন না।
অপরিচিত ছেলেটি দ্বারের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আমাকে কিছুই জানাতে হবে না, বাইরে দাঁড়িয়ে দিদি নিজের কানেই সমস্ত শুনতে পাচ্চেন।
বাইরে দাঁড়িয়ে? ওইখানে?
প্রত্যুত্তরে ছেলেটি জবাব দিবার পূর্বেই শৈলেশ স্পষ্ট করিয়া বলিল, হাঁ, আমি জানি ক্ষেত্র, তিনি ওইখানে দাঁড়িয়ে।
উত্তর শুনিয়া ক্ষেত্রমোহন স্তব্ধ বিবর্ণ হইয়া বসিয়া রহিলেন।
সেইদিন ঘণ্টা দুই-তিন পরে ভগিনীকে লইয়া যখন অবিনাশ স্টেশন অভিমুখে রওনা হইল, তখন সোমেন তাহার পিসির বাড়িতে, তাহার পিতা কলেজগৃহে এবং ক্ষেত্রমোহন হাইকোর্টের বার-লাইব্রেরিতে বসিয়া।
পরদিন সকালে চায়ের টেবিলে বসিয়া বিভা স্বামীকে কটাক্ষ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, দাদা কি করচেন দেখলে?
ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, দেখলুম ত হাতে আছে একখানা বই, কিন্তু আসলে করচেন বোধ করি অনুশোচনা।
এ কাজটা তুমি কবে করবে?
কোন্টা? বই, না অনুশোচনা?
বিভা কহিল, বই তোমার হাতে আর মানাবে না, আমি শেষের কাজটাই বলচি।
ক্ষেত্রমোহন খোঁচা খাইয়া বলিলেন, ভাইকে ডেকে বাপের বাড়ি চলে গেলেই বোধ হয় করতে পারি।
বিভার মন আজ প্রসন্ন ছিল, সে রাগ করিল না। কহিল, ও কাজটা আমি বোধ হয় পেরে উঠব না। কারণ, হিঁদুয়ানির জপ-তপ এবং ছুঁই-ছুঁই করার বিদ্যেটা ছেলেবেলা থেকেই শিখে ওঠবার সুবিধে পাইনি।
স্ত্রীর কথায় ক্ষেত্রমোহন আজকাল প্রায়ই অসহিষ্ণু হইয়া পড়িতেন, এখন কিন্তু ক্রোধ সংবরণ করিয়া সহজকণ্ঠে বলিলেন, তোমার অতি বড় দুর্ভাগ্য যে, ও সুযোগ তুমি পাওনি। পেলে হয়ত এতবড় বিড়ম্বনা তোমার দাদার অদৃষ্টে আজ ঘটত না। এই বলিয়া তিনি ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেলেন।
চৌদ্দ
ভবানীপুরের সেই সুশিক্ষিতা পাত্রীটিকে পাত্রস্থ করিবার চেষ্টা পুনরায় আরম্ভ হইল, শুধু বিভা এবার স্বামীর আন্তরিক বিরাগের ভয়ে তাহাতে প্রকাশ্যে যোগ দিতে পারিল না, কিন্তু প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি নানা প্রকারে দেখাইতে বিরত রহিল না। কন্যাপক্ষ হইতে অনুরুদ্ধ হইয়া ক্ষেত্রমোহন একদিন সোজাসুজি প্রশ্ন করিল শৈলেশ অস্বীকার করিয়া সহজভাবেই কহিল, জীবনের অধিকাংশই ত গত হয়ে গেল ক্ষেত্র, বাকি কটা দিনের জন্যে আর নতুন ঝঞ্ঝাট মাথায় নিতে ভরসা হয় না। সোমেন আছে, বরঞ্চ আশীর্বাদ কর তোমরা, সে বেঁচে থাক—এ সবে আমার আর কাজ নেই।
মানুষের অকপট কথাটা বুঝা যায়, ক্ষেত্রমোহন মনে মনে আজ বেদনা বোধ করিলেন। ইহার পর হইতে তিনি আদালতের ফেরত প্রায়ই আসিতে লাগিলেন।