মনোরমার পিসীমা বাহিরে আসিলেন।
পারু?
হ্যাঁ,-মনো কোথায় পিসীমা?
সে ত পাঠশালায় গেছে-তুমি যাওনি?
আমি পাঠশালায় যাইনি-দেবদাও যায় না।
মনোরমার পিসীমাতা হাসিয়া কহিলেন,-তবে ত ভাল! তুমিও যাও না, দেবদাদাও যায় না?
না। আমরা কেউ যাইনে।
সে ভাল কথা; কিন্তু মনো পাঠশালায় গেছে।
পিসীমা বসিতে বলিলেন, কিন্তু পার্বতী ফিরিয়া আসিল। পথে রসিক পালের দোকানের কাছে তিনজন বৈষ্ণবী রসকলি পরিয়া খঞ্জনী-হাতে ভিক্ষায় চলিয়াছিল, পার্বতী তাহাদিগকে ডাকিয়া বলিল, ও বোষ্টমী! তোমরা গান করতে জান?
একজন ফিরিয়া চাহিল-জানি বৈ কি বাছা!
তবে গাও না।
তখন তিনজনেই ফিরিয়া দাঁড়াইল। একজন কহিল, অমনি কি গান হয় মা, ভিক্ষে দিতে হয়। চল, তোমাদের
বাড়ি গিয়ে গা’ব।
না, এইখানে গাও।
পয়সা দিতে হয় যে মা!
পার্বতী আঁচল দেখাইয়া কহিল, পয়সা নেই-টাকা আছে।
আঁচলে বাঁধা টাকা দেখিয়া তাহারা দোকান হইতে একটু দূরে গিয়া বসিল। তাহার পর খঞ্জনী বাজাইয়া তিনজনে গলা মিলাইয়া গান ধরিল। কি গান হইল, কি তাহার অর্থ-পার্বতী এ-সব কিছুই বুঝিল না। ইচ্ছা করিলেও হয়ত বুঝিতে পারিত না। কিন্তু মনটি তাহার সেই নিমেষে দেবদাদার কাছে ছুটিয়া গিয়াছিল।
গান শেষ করিয়া তাহারা কহিল, কৈ, কি ভিক্ষে দেবে দাও তো মা!
পার্বতী আঁচলের গ্রন্থি খুলিয়া টাকা-তিনটা তাহাদের হাতে দিল। তিনজনেই অবাক হইয়া তাহার মুখপানে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল।
একজন বলিল, কার টাকা বাছা?
দেবদাদার।
সে তোমকে মারবে না?
পার্বতী একটু ভাবিয়া কহিল, না।
একজন কহিল, বেঁচে থাক মা।
পার্বতী হাসিয়া কহিল, তোমাদের তিনজনের বেশ ভাগে মিলেচে, না গো?
তিনজনেই মাথা নাড়িয়া বলিল, তা মিলেচে। রাধারানী তোমার ভাল করুন। বলিয়া তাহারা আন্তরিক আশীর্বাদ করিয়া গেল, যেন এই দানশীলা ছোট মেয়েটি শাস্তি ভোগ না করে। পার্বতী সেদিন সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া আসিল। পরদিন সকালবেলাই দেবদাসের সহিত তাহার দেখা হইল। তার হাতে একটা লাটাই ছিল-তবে ঘুড়ি নাই, সেইটা কিনিতে হইবে। পার্বতীকে কাছে পাইয়া কহিল, পারু, টাকা দে।
পার্বতীর মুখ শুকাইল,-বলিল, টাকা নেই!
কি হল?
বোষ্টমীদের দিয়ে দিয়েচি। তারা গান গেয়েছিল।
সব দিয়ে দিয়েচিস?
সব। তিনটি টাকা ত ছিল।
দূর গাধা, সব বুঝি দিতে হয়!
বাঃ! তারা যে তিনজন ছিল! তিন টাকা না দিলে তিনজনের কি ভাগে মেলে?
দেবদাস গম্ভীর হইয়া বলিল, আমি হলে দুই টাকা দিতুম, বলিয়া সে লাটাইয়ের বাঁট দিয়া মাটির উপর আঁচড় কাটিয়া কহিল, তা হলে তারা দশ আনা তের গণ্ডা এক কড়া এক ক্রান্তি ভাগে পেত।পার্বতী ভাবিয়া কহিল, তারা কি তোমার মত আঁক কষতে জানে?
দেবদাস মণকষা পর্যন্ত পড়িয়াছিল; পার্বতীর কথাটায় খুশী হইয়া কহিল, তা বটে!
পার্বতী দেবদাসের হাত ধরিয়া বলিল, আমি ভেবেছিলুম তুমি আমাকে মারবে, দেবদা।
দেবদাস বিস্মিত হইল-মারব কেন?
বোষ্টমীরা বলেছিল, তুমি আমাকে মারবে।
কথা শুনিয়া দেবদাস মহা খুশী হইয়া পার্বতীর কাঁধের উপর ভর দিয়া কহিল, দূর- না দোষ করলে কি আমি
মারি?
দেবদাস বোধ হয় মনে করিয়াছিল যে, পার্বতীর এ কাজটা তাহার পিনাল কোডের ভিতরে পড়ে না; কেননা, তিন টাকা তিনজনে বেশ ভাগ করিয়া লইতে পারিয়াছে। বিশেষতঃ, যে বোষ্টমীরা পাঠশালায় মণকষা পর্যন্ত পড়ে নাই তাহাদিগকে তিন টাকার বদলে দুই টাকা দিলে, তাহাদের প্রতি কতকটা অত্যাচার করা হইত। তাহার পর সে পার্বতীর হাত ধরিয়া ঘুড়ি কিনিবার জন্য ছোটবাজারের দিকে চলিল,-লাটাইটা সেইখানে একটা ঝোপের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া দিল।
দেবদাস – ০৪
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
এমনি করিয়া এক বৎসর কাটিল বটে, কিন্তু আর কাটিতে চাহে না। দেবদাসের জননী বড় গোলযোগ করিতে লাগিলেন। স্বামীকে ডাকিয়া বলিলেন, দেবা যে মুখ্যু চাষা হয়ে গেল,-একটা যা হয় উপায় কর।
তিনি ভাবিয়া বলিলেন, দেবা কলকাতায় যাক। নগেনের বাসায় থেকে বেশ পড়াশুনা করতে পারবে।
নগেনবাবু সম্পর্কে দেবদাসের মাতুল হইতেন। কথাটা সবাই শুনিল। পার্বতী শুনিয়া ভীত হইয়া উঠিল। দেবদাসকে একা পাইয়া তাহার হাত ধরিয়া ঝুলিতে ঝুলিতে বলিল, দেবদা, তুমি বুঝি কলকাতা যাবে?
কে বললে?
জেঠামশাই বলেচেন।
দূর-আমি কিছুতে যাব না।
আর যদি জোর করে পাঠিয়ে দেন?
জোর?
দেবদাস এই সময় এমন একটা মুখের ভাব করিল, যাহাতে পার্বতী বেশ বুঝিল যে, জোর করিয়া কোন কাজ তাহাকে দিয়া করাইবার জন্য এ পৃথিবীতে কেহ নাই। সেও ত তাহাই চায়। অতএব, নিরতিশয় আনন্দে আর একবার তাহার হাত ধরিয়া, আর একবার ঝুলিয়া এ-পাশ ও-পাশ করিয়া মুখপানে চাহিয়া হাসিয়া কহিল, দেখো, যেন যেয়ো না দেবদা।
কখ্খন না-
এ প্রতিজ্ঞা কিন্তু তাহার রহিল না। তাহার পিতা রীতিমত বকাঝকা করিয়া, এমন কি তিরস্কার ও প্রহার করিয়া ধর্মদাসকে সঙ্গে দিয়া তাহাকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলেন। যাইবার দিন দেবদাস মনের মধ্যে বড় কেশ অনুভব করিল; নূতন স্থানে যাইতেছে বলিয়া তাহার কিছুমাত্র কৌতূহল বা আনন্দ হইল না। পার্বতী সেদিন তাহাকে কিছুতেই ছাড়িতে চাহে না। কত কান্নাকাটি করিল, কিন্তু কে তাহার কথা শুনিবে? প্রথমে অভিমানে কিছুক্ষণ দেবদাসের সহিত কথা কহিল না; কিন্তু শেষে যখন দেবদাস ডাকিয়া বলিল, পারু, আবার শিগগির আসব; যদি না পাঠিয়ে দেয় ত পালিয়ে আসব।