কি জানি!
আমার মাথার দিব্যি রইল।
আচ্ছা-দেখব।
দেবদাস – ১০
দশম পরিচ্ছেদ
পার্বতী আসিয়া দেখিল, তাহার স্বামীর মস্ত বাড়ি। নূতন সাহেবী ফ্যাশনের নহে, পুরাতন সেকেলে ধরনের। সদর মহল, অন্দর মহল, পূজার দালান, নাটমন্দির, অতিথিশালা, কাছারি-বাড়ি, তোশাখানা, কত দাসদাসী-পার্বতী অবাক হইয়া গেল। সে শুনিয়াছিল, তাহার স্বামী বড়লোক, জমিদার। কিন্তু এতটা ভাবে নাই। অভাব শুধু লোকের। আত্মীয়, কুটু’-কুটু’িনী কেহই প্রায় নাই। অতবড় অন্দর মহল জনশূন্য। পার্বতী বিয়ের কনে, একেবারে গৃহিণী হইয়া বসিল। বরণ করিয়া ঘরে তুলিবার জন্য একজন বৃদ্ধা পিসী ছিলেন। ইনি ভিন্ন কেবল দাসদাসীর দল।
সন্ধ্যার পূর্বে একজন সুশ্রী সুন্দর বিংশবর্ষীয় যুবাপুরুষ প্রণাম করিয়া অদূরে দাঁড়াইয়া কহিল, মা, আমি তোমার বড়ছেলে।
পার্বতী অবগুণ্ঠনের মধ্য দিয়া ঈষৎ চাহিয়া দেখিল, কথা কহিল না। সে আর একবার প্রণাম করিয়া কহিল, মা, আমি তোমার বড়ছেলে-প্রণাম করি।
পার্বতী দীর্ঘ অবগুণ্ঠন কপালের উপর পর্যন্ত তুলিয়া দিয়া এবার কথা কহিল। মৃদুকণ্ঠে বলিল, এস বাবা, এস।
ছেলেটির নাম মহেন্দ্র। সে কিছুক্ষণ পার্বতীর মুখপানে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল; তৎপর অদূরে বসিয়া পড়িয়া বিনীতস্বরে বলিতে লাগিল, আজ দুবছর হল আমরা মা হারিয়েচি। এই দুবছর আমাদের দুঃখে-কষ্টেই দিন কেটেচে। আজ তুমি এলে,-আশীর্বাদ কর মা, এবার যেন সুখে থাকতে পাই।
পার্বতী বেশ সহজ গলায় কথা কহিল। কেননা, একেবারে গৃহিণী হইতে হইলে অনেক কথা জানিবার এবং বলিবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ কাহিনী অনেকের কাছেই হয়ত একটু অস্বভাবিক শুনাইবে। তবে যিনি পার্বতীকে আরও একটু ভাল করিয়া বুঝিয়াছেন তিনি দেখিতে পাইবেন, অবস্থার এই নানারূপ পরিবর্তনে পার্বতীকে তাহার বয়সের অপেক্ষা অনেকখানি পরিপক্ব করিয়া দিয়াছিল। তা ছাড়া নিরর্থক লজ্জা-শরম, অহেতুক জড়তা-সঙ্কোচ তাহার কোনদিনই ছিল না। সে জিজ্ঞাসা করিল, আমার আর সব ছেলেমেয়েরা কোথায় বাবা?
মহেন্দ্র একটু হাসিয়া বলিল, বলচি। তোমার বড় মেয়ে, আমার ছোটবোন তার শ্বশুরবাড়িতেই আছে। আমি চিঠি লিখেছিলুম, কিন্তু যশোদা কিছুতেই আসতে পারলে না।
পার্বতী দুঃখিত হইল; জিজ্ঞাসা করিল, আসতে পারলে না, না ইচ্ছা করে এলো না?
মহেন্দ্র লজ্জা পাইয়া কহিল, ঠিক জানিনে মা।
কিন্তু তাহার কথার ও মুখের ভাবে পার্বতী বুঝিল, যশোদা রাগ করিয়াই আইসে নাই; কহিল, আর আমার ছোটছেলে?
মহেন্দ্র কহিল, সে শিগগির আসবে। কলকাতায় আছে, পরীক্ষা দিয়েই আসবে।
ভুবন চৌধুরী নিজেই জমিদারির কাজকর্ম দেখিতেন। তা ছাড়া, স্বহস্তে নিত্য শালগ্রাম-শিলার পূজা করা, ব্রত-নিয়ম-উপবাস, ঠাকুরবাড়ি ও অতিথিশালায় সাধু-সন্ন্যাসীর পরিচর্যা-এই সব কাজে তাঁহার সকাল হইতে রাত্রি দশটা-এগারটা পর্যন্ত কাটিয়া যাইত। নূতন বিবাহ করিয়া কোনপ্রকার নূতন আমোদ-আহ্লাদ তাঁহাতে প্রকাশ পাইল না। রাত্রে কোনদিন ভিতরে আসিতেন, কোনদিন বা আসিতে পারিতেন না। আসিলেও অতি সামান্যই কথাবার্তা হইত-শয্যায় শুইয়া পাশবালিশটা টানিয়া লইয়া, চোখ বুজিয়া বড়জোর বলিতেন, তা তুমিই হলে বাড়ির গৃহিণী, সব দেখেশুনে, বুঝেপড়ে নিজেই নিয়ো-
পার্বতী মাথা নাড়িয়া বলিত, আচ্ছা।
ভুবন বলিতেন, আর দেখ, তা এই ছেলেমেয়েরা,-হাঁ, তা এরা তোমারই ত সব-
স্বামীর লজ্জা দেখিয়া পার্বতীর চোখের কোণে হাসি ফুটিয়া বাহির হইত। তিনি আবার একটু হাসিয়া কহিতেন, হাঁ, আর এই দেখ, এই মহেন তোমার বড়ছেলে, সেদিন বি এ পাস করেছে,-এমন ভাল ছেলে, এমন দয়ামায়া-কি জান, একটু যত্ন-আত্মীয়তা-
পার্বতী হাসি চাপিয়া বলিত, আমি জানি, সে আমার বড়ছেলে-
তা জানবে বৈ কি! এমন ছেলে কেউ কখনও দেখেনি। আর আমার যশোমতী, মেয়ে ত নয়-প্রতিমা। তা আসবে বৈ কি! আসবে বৈ কি! বুড়ো বাপকে দেখতে আসবে না! তা সে এলে তাকে-
পার্বতী নিকটে আসিয়া টাকের উপর মৃণালহস্ত রাখিয়া মৃদুস্বরে বলিত, তোমাকে ভাবতে হবে না। যশোকে আনবার জন্য আমি লোক পাঠাব-নাহয় মহেন নিজেই যাবে।
যাবে! যাবে! আহা, অনেকদিন দেখিনি-তুমি লোক পাঠাবে?
পাঠাব বৈ কি। আমার মেয়ে, আমি আনতে পাঠাব না!
বৃদ্ধ এই সময়ে উৎসাহে উঠিয়া বসিতেন। উভয়ের স’ন্ধ ভুলিয়া পার্বতীর মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া কহিতেন-তোমার ভাল হবে। আমি আশীর্বাদ করচি-তুমি সুখী হবে-ভগবান তোমার দীর্ঘায়ু করবেন।
তাহার পর হঠাৎ কি-সব কথা বৃদ্ধের যেন মনে পড়িয়া যাইত। পুনরায় শয্যায় শুইয়া পড়িয়া, চক্ষু মুদিয়া মনে মনে বলিতেন, বড়মেয়ে, ঐ এক মেয়ে,-সে বড় ভালবাসত-
এ সময়ে কাঁচা-পাকা গোঁফের পাশ দিয়া একফোঁটা চোখের জল বালিশে আসিয়া পড়িত। পার্বতী মুছাইয়া দিত। কখনো কখনো বা চুপি চুপি বলিতেন, আহা, তারা সবাই আসবে, আর-একবার বাড়িঘরদোর জমজম করবে-আহা, আগে কি জমকালো সংসারই ছিল! ছেলেরা, মেয়ে, গিন্নী-হৈচৈ-নিত্য দুর্গোৎসব। তারপর একদিন সব নিবে গেল। ছেলেরা কলকাতায় চলে গেল, যশোকে তার শ্বশুর নিয়ে গেল। তারপর অন্ধকার শ্মশান-
এই সময় আবার গোঁফের দু’পাশ ভিজিয়া বালিশ ভিজিতে শুরু করিত। পার্বতী কাতর হইয়া মুছাইয়া দিয়া কহিত, মহেনের কেন বিয়ে দিলে না?
বুড়ো বলিতেন, আহা, সে ত আমার সুখের দিন। তাইত ভেবেছিলাম কিন্তু কি যে ওর মনের কথা, কি যে ওর জিদ-কিছুতেই বিয়ে করল না। তাইত বুড়ো বয়সে-বাড়ি ঘর খাঁখাঁ করে, লক্ষ্মীছাড়া বাড়ির মতই সমস্তই মলিন, একটা জলুস কিছুতেই দেখতে পাইনে-তাইতেই-