সহসা কে একজন আসিয়া তাহার শিয়রের দিকে বসিয়া পড়ার চাপে তুচ্ছ ক্যাম্প-খাটখানা মচ্ করিয়া উঠিল। জীবানন্দ চমকিয়া চাহিয়া কহিল, কে? বারান্দায় প্রবেশ করিবার পদশব্দও সে কাহারও পায় নাই, যে বসিয়াছিল সে তাহার কপালের উপর একটা হাত রাখিয়া কহিল, আমি।
জীবানন্দ হাত বাড়াইয়া সেই হাতখানি নিজের দুর্বল হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর আস্তে আস্তে বলিল, এই নৌকাতে তুমি এলে?
হ্যাঁ।
রায়মহাশয় তোমাকে ধরে নিয়ে এলেন, তাঁকে বাঁচাতে হবে?
হাঁ, কিন্তু সে হৈমর বাবাকে, জনার্দন রায়কে নয়।
বুঝেচি। কিন্তু প্রজারা মকদ্দমা ছাড়বে কেন, সাগর স্বীকার করবে কেন?
আমার কাছে তারা স্বীকার করেচে।
করেচে? আশ্চর্য! বলিয়া সে চুপ করিয়া রহিল।
ষোড়শী কহিল, না আশ্চর্য নয়। তারা আমাকে মা বলে।
আমি তা জানি। জীবানন্দের হাতের মুঠা শিথিল হইয়া আসিল। সে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, ভালই হয়েছে। আজ সকাল থেকেই আমি ভাবছিলাম অলকা, এই ভয়ানক শক্ত কাজ আমি করব কি করে? আমি বাঁচলাম, আর আমার কিছুই করবার রইল না। তুমি সমস্তই করে দিয়েচ।
ষোড়শী মাথা নাড়িয়া কহিল, তোমার করবার আর কিছু না থাকতে পারে, কিন্তু আমার কাজ এখনো বাকী রয়ে গেছে। এই বলিয়া সে জীবানন্দের যে হাতটা স্খলিত হইয়া বিছানায় পড়িয়াছিল, তাহা নিজের মুঠোর মধ্যে গ্রহণ করিয়া তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া কহিল, নৌকা আমার প্রস্তুত, কোনমতে তোমাকে নিয়ে পালাতে পারলেই আমার এইসকল কাজের বড় কাজটা সারা হয়। চল। এই বলিয়া সে হেঁট হইয়া মাথাটা তাহার জীবানন্দের বুকের উপর রাখিয়া স্থির হইয়া রহিল। বহুক্ষণ কেহই কোন কথা কহিল না, কেবল একজনের প্রবল বক্ষস্পন্দন আর একজন নিঃশব্দে অনুভব করিতে লাগিল।
জীবানন্দ কহিল, কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে?
ষোড়শী কহিল, যেখানে আমার দু’চোখ যাবে।
কখন যেতে হবে?
এখনই। সাহেব এসে পড়ার আগেই।
জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া ধীরে ধীরে কহিল, কিন্তু আমার প্রজারা? তাদের কাছে আমাদের পুরুষানুক্রমে জমা করা ঋণ?
ষোড়শী তাহার দৃষ্টি এড়াইয়া চুপি চুপি বলিল, পুরুষানুক্রমে আমাদের তা শোধ দিতে হবে।
জীবানন্দ খুশী হইয়া বলিল, ঠিক কথা অলকা। কিন্তু দেরি করলে ত চলবে না। এখন থেকে ত আমাদের দু’জনকে এ ভার মাথায় নিতে হবে।
ষোড়শী সহসা দুই হাত জোড় করিয়া কহিল, হুজুর, দাসীকে এইটুকু শুধু ভিক্ষে দেবেন, প্রজাদের ভার নেবার চেষ্টা করে আর ভারী করে তুলবেন না। সমস্ত জীবন ধরেই ত নানাবিধ ভার বয়ে এসেছেন, এখন অসুস্থ দেহ একটু বিশ্রাম করলে কেউ নিন্দে করবে না। কিন্তু কে সাহেব এসে পড়তে পারে, চলুন।
প্রত্যুত্তরে জীবানন্দ শুধু একটুখানি হাসিয়া তাহার হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, এমন করে আমার সমস্ত ক্ষমতা তুমি কেড়ে নিয়ো না অলকা—আমাকে দুঃখীর কাজে লাগিয়ে দেখো কখ্খনো ঠকবে না।
কথা শুনিয়া অলকার দু’চক্ষু ছলছল করিয়া আসিল, এবং এমন একান্ত আত্মসমর্পণের দ্বারা যে তাহার সর্বস্ব জয় করিয়া লইয়াছে, তাহারই মুখের প্রতি চাহিয়া তাহার পদতলের মাটিটা পর্যন্ত যেন অকস্মাৎ কাঁপিয়া দুলিয়া উঠিল, কিন্তু আপনাকে সে তৎক্ষণাৎ সংবরণ করিয়া লইয়া হাতের উপরে একটু চাপ দিয়া হাসিয়া বলিল, আচ্ছা চল ত এখন। নৌকাতে বসে তখন ধীরে-সুস্থে ভেবে দেখবো কি কি ক্ষমতা তোমাকে দেওয়া যেতে পারবে এবং কি কি একেবারেই দেওয়া চলবে না।
সেই ভালো! বলিয়া জীবানন্দ ষোড়শীর হাত ধরিয়া অগ্রসর হইল।