বাতির আলোকে ষোড়শী কম্পিতহস্তে বাক্স খুলিয়া শিশি বাহির করিল, এবং সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কতটুকু দিতে হবে?
জীবানন্দ তীব্র বেদনায় আবার একটা অব্যক্ত ধ্বনি করিয়া কহিল, ঐ ত বললুম খুব একটুখানি। আমি উঠতেও পারচি নে, আমার হাতেরও ঠিক নেই, চোখেরও ঠিক নেই। ওতেই একটা কাঁচের ঝিনুক আছে, তার অর্ধেকেরও কম। একটু বেশি হয়ে গেলে এ ঘুম তোমার চণ্ডীর বাবা এসেও ভাঙ্গাতে পারবে না।
ষোড়শী সন্ধান করিয়া ঝিনুক বাহির করিল, কিন্তু পরিমাণ স্থির করিতে তাহার হাত কাঁপিতে লাগিল। তার পরে অনেক যত্নে অনেক সাবধানে যখন সে নির্দেশমত ঔষধ লইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, তখন নির্বিচারে সেই বিষ হাত বাড়াইয়া লইয়া জীবানন্দ মুখে ফেলিয়া দিল। প্রশ্ন করিল না, পরীক্ষা করিল না, একবার চোখ মেলিয়া দেখিল না।
দেনা-পাওনা – ০৪
চার
পার্শ্বের অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাখিয়া বাহির হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া মহাবীর চলিয়া গেল, কিন্তু ভিতর হইতে বন্ধ করিবার উপায় না থাকায় ষোড়শী সেই রুদ্ধ দ্বারেই পিঠ দিয়া অত্যন্ত সতর্ক হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার দেহ ও মন শ্রান্তি ও অবসাদের শেষ সীমায় আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, এবং রাত্রের মধ্যেও হয়ত আর কোন বিপদের সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু তথাপি ঘুমাইয়া পড়াও ত কোনমতে চলিবে না। এখানে একবিন্দু শৈথিল্যের স্থান নাই। এখানে একান্ত অসম্ভবের বিরুদ্ধেও তাহাকে সর্বতোভাবে জাগ্রত থাকিতে হইবে।
কিন্তু বাকী রাত্রিটা যেমন করিয়াই কাটুক, কাল তাহার সতীত্বের অতিশয় কঠোর পরীক্ষা হইবে তাহা সে নিজের কানেই শুনিয়াছে এবং ইহা হইতে বাঁচিবার কি উপায় আছে তাহাও তাহার সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত।
নিজের পিতার কথা মনে করিয়া ষোড়শী ভরসা পাইবে কি লজ্জায় মরিয়া গেল। তাঁহাকে সে ভাল করিয়াই চিনিত, তিনি যেমন ভীতু, তেমনি নীচাশয়। অনেক রাত্রে ঘরে ফিরিয়া এ দুর্ঘটনা জানিয়াও হয়ত তিনি প্রকাশ করিবেন না, বরঞ্চ সামাজিক গোলযোগের ভয়ে চাপিয়া দিবারই চেষ্টা করিবেন। মনে মনে এই বলিয়া তর্ক করিবেন, ষোড়শীকে একদিন জমিদার ছাড়িয়া দিবেই, কিন্তু কথাটা ঘাঁটাঘাঁটি করিয়া দেব-সম্পত্তি হইতেই যদি বঞ্চিত হইতে হয় ত লাভের চেয়ে লোকসানের অঙ্কটাই ঢের বেশী ভারী হইয়া উঠিবে।
উপরন্তু নজরের টাকাটার সম্বন্ধেও যে তাঁহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি বহুদূর অগ্রসর হইয়া যাইবে ইহাও ষোড়শী স্পষ্ট দেখিতে লাগিল। তা ছাড়া, এই দুর্দান্ত ভূস্বামীর বিরুদ্ধে তিনি করিবেনই বা কি! ছয়-সাত ক্রোশের মধ্যে একটা থানা নাই, চৌকি নাই—পুলিশের কাছে খবর দিতে গেলেও যে পরিমাণ সময়, অর্থ এবং লোকবলের প্রয়োজন তাহার কোনটাই তারাদাসের নাই। অতএব অত্যাচার যত বড়ই হোক, এই সুবৃহৎ শক্তির সম্মুখে অবনতশিরে সহ্য করা ব্যতীত আর যে গত্যন্তর নাই, এই কথাটাই চোখে আঙ্গুল দিয়া ষোড়শীকে বার বার দেখাইয়া দিতে লাগিল।
অথচ সমস্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে মিশিয়া তাহার আর একটা চিন্তার ধারা নীরবে অনুক্ষণ বহিয়া যাইতেছিল—সে ওই তাহার চণ্ডীমাতা, যাঁহাকে শিশুকাল হইতে সে কায়মনে পূজা করিয়া আসিয়াছে। কিন্তু ঐ যে লোকটা ও-ঘরে ঘুমাইতেছে—যাহার গূঢ়, ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ অস্পষ্ট হইয়া তাহার কানে পৌঁছিতেছে, উহার ধর্ম ও অধর্ম, ভাল ও মন্দ, আপনার ও পর—পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর প্রতি কি গভীর নির্মম অবহেলা!
নারীর চোখের জলে উহার করুণা নাই, রমণীর রূপ ও যৌবনে উহার মমতা নাই, আকর্ষণ নাই, স্বামী-পুত্রবতীর সতীধর্মকে নিতান্ত নিরর্থক হত্যা করিতে উহার বাধে না, তাহাদের হৃদয়ের রক্তে দুই পা ভরিয়া গেলেও ভ্রূক্ষেপ করে না, যে নিজের প্রাণটাকে পর্যন্ত এইমাত্র তাহার হাতে তুলিয়া দিয়া তাহারি প্রদত্ত বিষ অসঙ্কোচে চোখ মুদিয়া ভক্ষণ করিল, এতটুকু দ্বিধা করিল না, অশ্রদ্ধা ও অনাসক্তির এই অপরিমেয় পাষাণ-ভার ঠেলিয়া কি মা-চণ্ডীই তাহার পরিত্রাণের পথ করিতে পারিবেন!
এমনি করিয়া সে যেদিকে দৃষ্টিপাত করিল নিদারুণ আঁধার ব্যতীত এতটুকু আলোক-রশ্মিও চোখে পড়িল না। তখন পরিপূর্ণ নিরাশ্বাস তাহার ওই একমাত্র দেবতার মন্দির ঘুরিয়াই কেবল কল্পনার জাল বুনিতে লাগিল।
ভোরের দিকে বোধ করি সে একটুখানি তন্দ্রাভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ পিঠের উপর একটা চাপ অনুভব করিয়া ধড়মড় করিয়া সোজা উঠিয়া বসিয়া দেখিল, জানালা দিয়া সূর্যের আলোক ঘরে প্রবেশ করিয়াছে।
বাহির হইতে যে দ্বার ঠেলিতেছিল, সে কহিল, আপনি বেরিয়ে আসুন, আমি এককড়ি।
ষোড়শী গায়ের বস্ত্র সংযত করিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং দ্বার খুলিয়া সম্মুখেই দেখিতে পাইল, গত রাত্রির সেই শয্যার উপর জীবানন্দ প্রায় তেমনিভাবেই বালিশে ঠেস দিয়া বসিয়া আছে। কাল দীপের স্বল্প আলোকে তাহার মুখখানা ষোড়শী ভাল দেখিতে পায় নাই, কিন্তু আজ একমুহূর্তের দৃষ্টিপাতেই দেখিতে পাইল সুদীর্ঘ অত্যাচার তাহার দেহের প্রতি অঙ্গে কত বড় গভীর আঘাত করিয়াছে। বয়স ঠিক অনুমান হয় না—হয়ত চল্লিশ, হয়ত আরও বেশী—রগের দুইধারে কিছু কিছু চুল পাকিয়াছে, প্রশস্ত ললাট রেখায় ভরা, তাহারি উপরে কালো কালো ছাপ পড়িয়াছে। যক্ষ্মারোগীর চোখের মত দৃষ্টি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ এবং তাহারই নীচে শীর্ণ নাকটা যেন খাঁড়ার মত ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সমস্ত মুখখানা অত্যন্ত ম্লান, তাহারই সঙ্গে মিশিয়া ভিতরের কি একটা অব্যক্ত বেদনা যেন কালিমাব্যাপ্ত করিয়া দিয়াছে।