জীবানন্দ চুপ করিয়া রহিল। ষোড়শী কাগজখানি হাতের পর মেলিয়া ধরিয়া হেঁট হইয়া সেই ছত্র-কয়েকের লিখনটুকু একনিঃশ্বাসে পড়িয়া ফেলিয়া নির্বাক্ ও নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বাহিরে তাহার নাম লিখা থাকিলেও, বস্তুত এ পত্র তাহার নয়। ভিতরে ছিল—
ফকিরসাহেব,
ষোড়শীর আসল নাম অলকা। সে আমার স্ত্রী। আপনার কুষ্ঠাশ্রমের কল্যাণ কামনা করি, কিন্তু তাহাকে দিয়া কোন ছোট কাজ করাইবেন না। আশ্রম যেখানে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন সে আমার নয়, কিন্তু তাহার সংলগ্ন শৈবাল-দীঘি আমার। এই গ্রামের মুনাফা পাঁচ ছয় হাজার টাকা। আপনাকে জানি। কিন্তু আপনার অবর্তমানে পাছে কেহ তাহাকে নিরুপায় মনে করিয়া অমর্যাদা করে, এই ভয়ে আশ্রমের জন্যই গ্রামখানি তাহাকে দিলাম। আপনি নিজে একদিন আইন ব্যবসায়ী ছিলেন, এই দান পাকা করিয়া লইতে যাহা-কিছু প্রয়োজন, করিবেন; সে খরচ আমিই দিব। কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলে আমি সহি করিয়া রেজিস্টারী করিয়া দিব।
ষোড়শী বাহিরে গিয়া তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া ফেলিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, তুমি এত খবর কোথায় পেলে? আমি যে কুষ্ঠাশ্রমের দাসী হয়ে যাচ্চি এই বা তুমি জানলে কি করে?
জীবানন্দ কহিল, কুষ্ঠাশ্রমের কথা অনেকেই জানে। আর তোমার কথা? আজই দেবতার স্থানে দাঁড়িয়ে যারা শপথ করে গেল, নিজের কানে শুনেও অন্ধকারে আমি যাদের চিনতে পারিনি, তুমি তাদের চিনলে কি করে?
ষোড়শী ইহার ঠিক জবাবটা দিতে না পারিয়া হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, তোমার কি সংসারে আর মন নেই? সমস্ত বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে কি তুমি সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে চাও নাকি?
প্রশ্নটা দুজনের কানেই অদ্ভুত ঠেকিল। জীবানন্দ প্রথমে জবাব দিতে পারিল না, কিন্তু দেখিতে দেখিতে সে কিরকম উত্তেজিত হইয়া উঠিল। বলিল, আমি সন্ন্যাসী? মিছে কথা। সংসারে আর আমি কিছুই নষ্ট করতে পারব না। এখানে আমি বাঁচতে চাই—মানুষের মাঝখানে মানুষের মত বাঁচতে চাই। বাড়ি চাই, ঘর চাই, স্ত্রী চাই, ছেলেপুলে চাই—আর মরণ যেদিন আটকাতে পারব না, সেদিন তাদের চোখের উপর দিয়েই চলে যেতে চাই। আমার অনেক গেছে, কত যে গেছে শুনলে তুমি চমকে যাবে—কিন্তু আর আমি লোকসান করতে পারব না।
ষোড়শী সভয়ে আস্তে আস্তে বলিল, কিন্তু আমি ত সন্ন্যাসিনী। পৃথিবীতে স্ত্রীলোকের অভাব নেই—কিন্তু এর মধ্যে আমাকে তুমি জড়াতে চাইচ কেন?
জীবানন্দ চুপ করিয়া রহিল। পৃথিবীতে স্ত্রীলোকের অভাব আছে কি নাই, এ কথা তাহাকে বলিবার স্পর্ধা যাহার হইল তাহাকে সে আর কি বলিবে?
গাড়োয়ান প্রাঙ্গণ হইতে তাড়া দিয়া বলিল, মা, রাত পোহাতে যে আর দেরি নেই।
চল বাবা, যাচ্চি। বলিয়া ষোড়শী তেলটুকু প্রদীপের মধ্যে ঢালিয়া দিয়া ক্ষীণ দীপশিখা সমুজ্জ্বল করিয়া দিয়া বাহির হইয়া আসিল। ঘরে তালা বন্ধ করিবার আবশ্যক ছিল না, জীর্ণদ্বারে শুধু শিকলটি তুলিয়া দিয়া, গলায় অঞ্চল দিয়া জীবানন্দের পদপ্রান্তে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া তাহার পদধূলি লইয়া কহিল, আমি চললাম।
জীবানন্দ কহিল, খাবার সময়টুকুও হল না।
না। প্রজারা জানে আমি ভোরবেলায় যাত্রা করব, তারা এসে পড়বার পূর্বেই আমার বিদায় হওয়া চাই। একটু হাসিয়া কহিল, এক-আধ দিন না খেলে আমাদের মরণ হয় না।
সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া জীবানন্দ তাহাকে গাড়িতে তুলিয়া দিল। গাড়ি ছাড়িয়া দিলে তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া কহিল, অলকা, তোমার মা একদিন তোমাকে আমার হাতে দিয়েছিলেন, তবু তোমাকে পেলাম না, কিন্তু সেদিন আমাকে যদি কেউ তোমার হাতে সঁপে দিতেন, আজ বোধ হয় তুমি অন্ধকারে আমাকে এমন করে ফেলে যেতে পারতে না।
ইহার জবাব ষোড়শী খুঁজিয়া পাইল না। শুধু কথাগুলোর একটা অব্যক্ত, অপরিসীম ব্যাকুল ধ্বনি তাহার দুই কান আচ্ছন্ন করিয়া রহিল। গাড়ি মোড় ফিরিবার পূর্বেও সে মুখ বাড়াইয়া দেখিল শেষ-নিশার প্রগাঢ় অন্ধকারে ঠিক সেইখানেই সে তেমনি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।
রাত্রি প্রভাত হইতে তখন খুব বেশী বিলম্ব ছিল না, জীবানন্দ মাঠের পথ ধরিয়া তাহার গৃহে ফিরিল। কিছুক্ষণ হইতে একটা অস্ফুট কোলাহল তাহার কানে যাইতেছিল, কিছুদূর অগ্রসর হইতেই সুমুখের আকাশে ঊষার আরক্ত আভার মত রাঙ্গা আলো তাহার চোখে পড়িল। এবং চলার সঙ্গে সঙ্গেই এই শব্দ ও আলোক উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিতে লাগিল। অবশেষে কাছাকাছি আসিয়া দেখিতে পাইল, বহুলোকের ব্যর্থ চীৎকার ও ছুটাছুটির মধ্যে বীজগ্রামের জমিদার-গোষ্ঠীর প্রমোদ-ভবন, তাহার মাতামহের অত্যন্ত সাধের শান্তিকুঞ্জ অগ্নিদাহে ভস্মীভূত হইতে আর বিলম্ব নাই।
দেনা-পাওনা – ২৬
ছাব্বিশ
সকাল হইতে না হইতে চণ্ডীগড়ের সমস্ত ইতর-ভদ্র হাহাকার করিয়া আসিয়া পড়িল। শিরোমণি আসিলেন, রায়মহাশয় আসিলেন, তারাদাস আসিলেন, এবং আরও অনেক ভদ্র ব্যক্তি—পোড়া শান্তিকুঞ্জের সব পুড়িল না, দৈবাৎ কিছু রক্ষা পাইল। এবং যাহা পুড়িল তাহার দাম কত, এবং যাহা বাঁচিল তাহা সামান্য এবং অকিঞ্চিৎকর কিনা, ইত্যাদি তথ্য সবিস্তারে ও নিশ্চয় করিয়া আহরণ করিতে ছুটিয়া আসিলেন। এবং ইহা কেমন করিয়া হইল ও কে করিল? সকলের মাঝখানে এককড়ি নন্দী তুমুল কাণ্ড করিতে লাগিল। সর্বনাশ যেন তাহারই হইয়া গেছে। সে সর্বসমক্ষে ডাক ছাড়িয়া প্রকাশ করিল যে, এ কাজ সাগর সর্দারের। সে ও তাহার জন-দুই সঙ্গীকে কেহ কেহ কাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত বাহিরে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখিয়াছে। থানায় এত্তেলা পাঠানো হইয়াছে, পুলিশ আসিল বলিয়া। সমস্ত ভূমিজ-গোষ্ঠীকে যদি না সে এই ব্যাপারে আন্দামানে পাঠাইতে পারে ত তাহার নাম এককড়ি নন্দী নয়-বৃথাই সে এতকাল হুজুরের সরকারে গোলামি করিয়া মরিল!