জীবানন্দ বুঝিল কথাটা তাহার ভাল হয় নাই। অপ্রতিভ হইয়া কহিল, ডাকতে কাউকে হবে না, আমি আপনিই যাচ্চি। যেতে আমার ইচ্ছে হয় না, তাই শুধু আমি বলছিলাম। তুমি কি সত্যই চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাবে অলকা?
আবার সেই নাম! জীবানন্দের মুখের পানে চাহিয়া তাহার ক্লেশ বোধ হইল, ঘাড় নাড়িয়া জানাইল যে সত্যই সে চলিয়া যাইবে।
কবে যাবে?
কি জানি, হয়ত কালই যেতে পারি।
কাল? কালই যেতে পারো? বলিয়া জীবানন্দ একেবারে স্তব্ধ হইয়া বসিল। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আশ্চর্য! মানুষের নিজের মন বুঝতেই কি ভুল হয়! যাতে তুমি যাও, সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করেছি, অথচ তুমি চলে যাবে শুনে চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়াটা যেন শুকনো হয়ে গেলো। নির্মলবাবু মস্ত লোক, মস্তবড় ব্যারিস্টার, তিনি আছেন তোমার পক্ষ নিয়ে—হাঙ্গামা বাধাবে, লড়াই শুরু হবে—আমরা জিতবো, ওই যে জমিটা দেনার দায়ে বিক্রি করেচি, ও নিয়ে আর কোন গোলমাল হবে না—কতকগুলো নগদ টাকাও হাতে এসে পড়বে, আর তোমাকে ত যা বলব তাই করতে হবে, এই দিকটাই কেবল দেখতে পেয়েচি, কিন্তু আর যে একটা দিক আছে—তুমি নিজেই সমস্ত ছেড়েছুড়ে দিয়ে বিদায় নিলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে, তামাশাটা কোথায় গিয়ে গড়াবে, তা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি—আচ্ছা অলকা, এমন ত হতে পারে, আমার মত তোমারও ভুল হচ্চে—তুমিও নিজের মনের ঠিক খবরটি পাওনি?
কথাগুলি এত চমৎকার এবং এমন নূতন যে হঠাৎ বিস্ময় লাগে, ইহা জীবানন্দের মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে। জবাব দিতে ষোড়শীর একটু থামিতে হইল। শেষে সায় দিয়া বলিল, হতে পারে বৈ কি। শুধু এই খবরটা নিশ্চয় জানি, যা আমি স্থির করেচি, সে আর অস্থির হবে না।
জীবানন্দ বলিয়া উঠিল, বাপরে বাপ! তোমার পুরুষমানুষ, আর আমার মেয়েমানুষ হওয়া উচিত ছিল; আচ্ছা, সেইখানেই বা তোমার চলবে কি করে?
ষোড়শী পূর্বের মতই সহজ গলায় উত্তর দিল, এ আলোচনা আমি আপনার সঙ্গে কোনমতে করতে পারিনে।
জীবানন্দ রাগ করিয়া বলিল, তুমি কিছুই পারো না, তুমি পাথর। চুলে আমার পাক ধরে এলো, আমি বুড়ো হয়ে গেলাম—তোমার কাছে কি এখন আমি হাতজোড় করে কাঁদতে পারি তুমি ভেবেচ?
ষোড়শী কহিল, দেখুন অনেক রাত্রি হ’লো, এখনো আমার আহ্নিক পর্যন্ত সারা হয়নি—
পুরোহিতের কাশি এবং পায়ের শব্দ বাহিরে শোনা গেল; সে দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল, মা, সকলের সম্মুখে মন্দিরের দোর বন্ধ করে চাবিটা আমি তারাদাস ঠাকুরের হাতেই দিলাম। রায়মশায়, শিরোমণি—এঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ষোড়শী কহিল, ঠিকই হয়েছে। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি সাগরের ওখানে একবার যাবো, বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল।
জীবানন্দ নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিল, এগুলোও তা হলে তুমি রায়মশায়ের কাছেই পাঠিয়ে দিয়ো।
ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না, সিন্দুকের চাবি আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না।
শুধু আমাকেই হবে?
ষোড়শী ইহার কোন উত্তর না দিয়া ঘরের তালাটা হাতে লইয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং জীবানন্দ বাহিরে আসিতেই কবাট বন্ধ করিয়া তাহার পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া পুরোহিতের পিছনে পিছনে নিঃশব্দে প্রস্থান করিল। শুধু একাকী জীবানন্দ সেই অন্ধকার বারান্দায় ভূতের মত নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
দেনা-পাওনা – ২৩
তেইশ
ব্যারিস্টার-সাহেব চলিয়া গেছেন, ষোড়শী চলিয়া যাইতেছে—মন্দিরের চাবি-তালা সরঞ্জাম প্রভৃতি যাহা কিছু মূল্যবান সমস্ত আদায় হইয়া গেছে, ইত্যাদি সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া পড়িতে কিছুমাত্র বিলম্ব ঘটিল না। শিরোমণি আনন্দের আবেগে মুক্তকচ্ছ আলুথালু বেশে রায়মহাশয়ের সদরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
নির্মলের যাবার সময়ে বিদায়ের পালাটা বিশেষ প্রীতিকর হয় নাই। মনে মনে বোধ করি এই সকল আলোচনাতেই জনার্দনের মুখমণ্ডল গম্ভীর ভাব ধারণ করিয়াছিল। কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য করিবার অবস্থা শিরোমণির ছিল না, তিনি আশীর্বাদের ভঙ্গীতে ডান হাত তুলিয়া গদগদ-কণ্ঠে কহিলেন, দীর্ঘজীবী হও ভায়া, সংসারে এসে বুদ্ধি ধরেছিলে বটে!
জনার্দন মুখ তুলিয়া কহিলেন, ব্যাপার কি?
শিরোমণি বলিলেন, ব্যাপার কি! দশখানা গাঁয়ে রাষ্ট্র হতে বাকী আছে নাকি? বেটী চাবিপত্র যা-কিছু সমস্ত দিয়ে চলে যাচ্ছে যে! বলি, শোননি নাকি?
যে ভদ্রলোক সকাল হইতে বসিয়া এ মাসে সুদের কিছু টাকা মাপ করিতে অনুনয়-বিনয় করিতেছিল, সে কহিল, বেশ! যজ্ঞেশ্বর জানলেন না, আর খবর পেলেন ঘেঁটুমনসা? এ-সব করলে কে শিরোমণি খুড়ো, সমস্তই ত রায়মশায়।
শিরোমণি আসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, কিন্তু আসল চাবিটা শুনচি নাকি গিয়ে পড়েচে জমিদারের হাতে? ব্যাটা পাঁড় মাতাল—দেখো ভায়া, শেষকালে মায়ের সিন্দুকের সোনারুপো না ঢুকে যায় শুঁড়ির সিন্দুকে। পাপের আর অবধি থাকবে না।
ক্রমশঃ একে একে গ্রামের অনেকেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। স্থির হইল, জমিদারের হাত হইতে চাবিটা অবিলম্বে উদ্ধার করা চাই। বেলা তৃতীয় প্রহরে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া হুজুর যখন মদ খাইতে আরম্ভ করিবেন, তাঁহার মাতাল হইয়া পড়িবার পূর্বেই সেটা হস্তগত করা প্রয়োজন। সেটা তাঁহার হাতে যাওয়ার সম্বন্ধে জনার্দন নিজের সামান্য একটু ত্রুটি ও অবিবেচনা স্বীকার করিয়া লইয়াই কহিলেন, সমস্তই স্থির করে রেখেছিলাম, হঠাৎ উনি যে মাঝ থেকে চাবি হাত করবেন, সেটা আর খেয়াল করিনি। এখন সহজে দিলে হয়। দশ দিন পরে হয়ত বলে বসবে, কৈ কিছুই ত সিন্দুকে ছিল না! কিন্তু আমরা সবাই জানি, ভায়া, ষোড়শী আর যাই কেন না করুক, মায়ের সম্পত্তি অপহরণ করবে না—একটি পাই পয়সা না।