নির্মল কহিল, আমি এখন তা হলে যাই—
আপনি বাড়ি ফিরবেন কবে?
আমার আর ত কোন প্রয়োজন নেই, হয়ত কালই ফিরতে পারি।
ছেলেকে, হৈমকে আমার আশীর্বাদ দেবেন।
নির্মল একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আমাকে আর বোধ হয় কোন আবশ্যক নেই?
ষোড়শী নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, এতবড় অহঙ্কারের কথা কি আমি বলতে পারি নির্মলবাবু? তবে মন্দির নিয়ে আর বোধ হয় আমার কখনো আপনাকে দুঃখ দেবার আবশ্যক হবে না।
নির্মল ম্লানমুখে হাসির প্রয়াস করিয়া কহিল, আমাদের শীঘ্র ভুলে যাবেন না আশা করি?
ষোড়শী মাথা নাড়িয়া শুধু কহিল, না।
নির্মল নমস্কার করিয়া কহিল, আমি চললাম। যদি সকালের গাড়িতে যাওয়া হয় ত, আর বোধ হয় দেখা করবার সময় পাবো না। হৈম আপনাকে বড় ভালবাসে, যদি অবকাশ পান মাঝে মাঝে একটা খবর দেবেন। বলিয়া সে আর কোন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করিয়া বাহির হইয়া গেল। প্রবঞ্চিতের লজ্জা ও জ্বালা অত্যন্ত সঙ্গোপনে তাহার বুকের মধ্যে ধকধক করিয়া জ্বলিতে লাগিল, এবং বিফল-মনোরথ মাতাল যেমন করিয়া তাহার মদের দোকানের রুদ্ধ-দুয়ার হইতে ফিরিবার পথে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকে, তেমনি করিয়া সে সমস্ত পথটা মনে মনে বলিতে লাগিল, আমি বাঁচিয়া গেলাম। স্বেচ্ছাচারিণীর মোহের বেষ্টন হইতে বাহির হইতে পারিয়া আমার হৈমকে আবার ফিরিয়া পাইলাম। কথাগুলো কেবলমাত্র বারংবার আবৃত্তি করিয়াই সে তাহার পীড়িত, আহত হৃদয়ের কাছে যেন সপ্রমাণ করিতে চাহিল যে, এ ভালই হইল যে, ষোড়শীর গৃহের দ্বার তাহার মুখের উপর চিরদিনের মত বন্ধ হইয়া গেল।
মিনিট দুই-তিন পরে জীবানন্দ বাহিরে আসিয়া দেখিল, অন্ধকারে একটা খুঁটি ঠেস দিয়া ষোড়শী চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কাছে আসিয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, নির্মলবাবু কি চলে গেলেন?
এ প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন ছিল না, ষোড়শী তেমনি চুপ করিয়াই রহিল।
জীবানন্দ কহিল, ভদ্রলোকটিকে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ষোড়শী পথের দিকে চাহিয়াছিল, সেইদিকেই চক্ষু রাখিয়া বলিল, তাতে আপনার ক্ষতি কি?
আমার ক্ষতি? না, তা বোধ করি কিছু নেই, কিন্তু তোমার ত থাকতে পারে? তুমি কি তাঁকে বুঝতে পেরেছ?
ষোড়শী কহিল, আমার যতটুকু দরকার তা পেরেছি বৈ কি।
তা হলে ভাল। বলিয়া সে ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া যেন নিজের মনেই কহিল, তাঁকে মনে রাখবার জন্যে কি রকম ব্যাকুল প্রার্থনা জানিয়ে গেলেন, দরখাস্ত মঞ্জুর করলে ত? বলিয়া মুখ তুলিয়া চাহিতে সেই অন্ধকারেও দু’জনের চোখে চোখে মিলিল।
ষোড়শী দৃষ্টি অবনত করিল না, বলিল, আমি তাঁকে যতখানি জানি, তার অর্ধেকও যদি আমাকে জানবার তাঁর সময় হতো, এতবড় বাহুল্য আবেদন আমার কাছে তিনি মুখে উচ্চারণ করতেও পারতেন না। আমার যা-কিছু কল্পনা, যত-কিছু আনন্দের ভাবনা, সে ত কেবল তাঁদের নিয়েই। তাঁদের দেখেই ত আমি সে-ষোড়শী আর নেই। এই যে চণ্ডীগড়ের ভৈরবী-পদ, যা ভাগ করে নেবার লোভে আপনাদের ছেঁড়াছিঁড়ির অবধি নেই, যে জন্যে কলঙ্কে দেশ আপনারা ছেয়ে দিলেন, সে যে আজ জীর্ণবস্ত্রের মত ত্যাগ করে যাচ্চি, সে শিক্ষা কোথায় পেয়েচি জানেন? সে ওইখানে। মেয়েমানুষের কাছে এ যে কত ফাঁকি, কত মিথ্যে, সে কথা ওঁদের দেখেই বুঝতে পেরেছি। অথচ এর বাষ্পও তিনি জানেন না, কোনদিন হয়ত জানতেও পারবেন না।
জীবানন্দ অবাক হইয়া চাহিয়া ছিল, সহসা সেইদিকে দৃষ্টি পড়ায় ষোড়শী নিজের উচ্ছ্বসিত আবেগে লজ্জিত হইয়া নীরব হইল। কিছুক্ষণ উভয়েই মৌন থাকার পরে জীবানন্দ ধীরে ধীরে কথা কহিল। বলিল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে আমার ভারী লজ্জা করে, কিন্তু যদি পারতাম, তুমি কি তার সত্যি জবাব দিতে পারতে অলকা?
জীবানন্দের মুখে এই অলকা নামটা ষোড়শীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তিন অক্ষরের এই ছোট্ট কথাটি তাহার কোন্খানে যে গিয়া আঘাত করিত, সে ভাবিয়া পাইত না। বিশেষ করিয়া তাহার প্রশ্ন করার এই কৌতুককর ভঙ্গীতে ষোড়শীর হাসি পাইল; কহিল, আপনি যদি কোন একটা আশ্চর্য কাজ করতে পারতেন, তার পরে আমি আর কোন একটা তেমনি অদ্ভুত কাজ করতে পারতাম কি না, এতবড় সত্য করবার শক্তি আমার নেই। কিন্তু সে-কাজ করবার আপনার আবশ্যক নেই—আমি বুঝেচি। অপবাদ আপনারা দিয়েচেন বলেই তাকে সত্যি করে তুলতে হবে, তার অর্থ নেই। আমি কিছুর জন্যেই কখনো কারও আশ্রয় গ্রহণ করব না। আমার স্বামী আছেন, কোন লোভেই সে-কথাটা আমি ভুলে যেতে পারব না। এই ভয়ানক প্রশ্নটাই না আপনাকে লজ্জা দিচ্ছিল চৌধুরীমশায়?
তুমি আমাকে চৌধুরীমশায় বল কেন?
তবে কি বলব? হুজুর?
না, অনেকে যা বলে ডাকে—জীবানন্দবাবু।
ষোড়শী বলিল, বেশ ভবিষ্যতে তাই হবে।
জীবানন্দ কহিল, ভবিষ্যতে কেন, আজই বল না?
ষোড়শী ইহার কোন উত্তর দিল না। ভিতরে প্রদীপ স্তিমিত হইয়া আসিতেছিল। সে ঘরে আসিয়া তাহা উজ্জ্বল করিয়া দিল। জীবানন্দ ফিরিয়া আসিয়া বসিতেই ষোড়শী বিস্মিত হইয়া কহিল, রাত্রি হয়ে যাচ্চে, আপনি বাড়ি গেলেন না? আপনার লোকজন কৈ?
আমি তাদের পাঠিয়ে দিয়েচি।
একলা বাড়ি যেতে আপনার ভয় করবে না?
না, আমার পিস্তল সঙ্গে আছে।
তবে তাই নিয়ে বাড়ি যান, আমার ঢের কাজ আছে।
জীবানন্দ কহিল, তোমার থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। আমি এখন যাবো না।
ষোড়শীর চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল, কিন্তু শান্তভাবে বলিল, রাত হয়েছে, আমি লোক ডেকে আপনার সঙ্গে দিচ্চি, তারা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে।