ব্যাপারটা নির্মলের একেবারে ভাল লাগিল না। সে বিরক্তি ও সঙ্কোচে আড়ষ্ট হইয়া বলিল, এ কথা আমাকে আপনি বলেন নি কেন?
বেশ! একবার তুমি একবার আপনি, বলিয়া সে হাসিয়া কহিল, ভয় নেই, উনি ভারী ভদ্রলোক, লড়াই করেন না। তা ছাড়া, আপনাদের ত পরিচয় নেই—সেটাও একটা লাভ। বলিয়া সে দ্বারের বাহিরে অগ্রসর হইয়া অভ্যর্থনা করিয়া কহিল, আসুন—আমার কুঁড়ে আর একবার পবিত্র হ’লো।
জীবানন্দ চৌকাঠে পা দিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, ইনি? নির্মলবাবু বোধ হয়?
ষোড়শী হাসিমুখে জবাব দিল, হাঁ, আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিলে খুব সম্ভব অতিশয়োক্তি হবে না।
দেনা-পাওনা – ২২
বাইশ
অনুমান যে ভুল নয়, লোকটি যে সত্য সত্যই নির্মল বসু, তাহা বুঝিতে পারিয়া জীবানন্দ প্রথমে চমকিত হইল, কিন্তু যে-কোন অবস্থায় নিজেকে মুহূর্তে সামলাইয়া লইবার শক্তি তাহার অদ্ভুত। সে সামান্য একটু হাসিয়া বলিল, বিলক্ষণ! বন্ধু নয় ত কি? ওঁদের কৃপাতেই ত টিকে আছি, নইলে মামার জমিদারি পাওয়া পর্যন্ত যে-সব কীর্তি করা গেছে, তাতে চণ্ডীগড়ের শান্তিকুঞ্জের বদলে ত এতদিন আন্দামানের শ্রীঘরে গিয়ে বসবাস করতে হতো।
নির্মলের গোড়া হইতেই ভাল লাগে নাই, কিন্তু নিজের দুষ্কৃতির এই লজ্জাহীন, অনাবৃত রসিকতার চেষ্টায় তাহার গা জ্বলিয়া গেল। মুখ লাল করিয়া কি একটা বলিতেও চাহিল, কিন্তু বলিতে হইল না। ষোড়শী জবাব দিল, কহিল, চৌধুরীমশায়, উকিল-ব্যারিস্টার বড়লোক বলে বাহবাটা কি একা ওঁরাই পাবেন? আন্দামান প্রভৃতি বড় ব্যাপার না হোক, কিন্তু ছোট বলে এ দেশের শ্রীঘরগুলোও ত মনোরম স্থান নয়—দুঃখী বলে ভৈরবীরা কি একটু ধন্যবাদ পেতে পারে না?
জীবানন্দ অপ্রস্তুত হইয়া হঠাৎ যাহা মুখে আসিল কহিল। বলিল, ধন্যবাদ পাবার সময় হলেই পাবে।
ষোড়শী হাসিয়া কহিল, এই যেমন মন্দিরে দাঁড়িয়ে এইমাত্র একদফা দিয়ে এলেন।
জীবানন্দ ইহার কোন জবাব দিল না। নির্মলের প্রতি চাহিয়া কহিল, আপনার শ্বশুরমহাশয়ের মুখে শুনলাম আপনি আসচেন—আশা করেছিলাম মন্দিরেই আলাপ হবে।
ষোড়শী বলিল, সে আমার দোষ চৌধুরীমশায়। উনি এসেও ছিলেন এবং সদালাপে যোগ না দিন, ভিড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে শোনবার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু আমি দেখতে পেয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলাম। বললাম, চলুন নির্মলবাবু, ঘরে বসে বরঞ্চ দুটো গল্প-সল্প করা যাক।
জীবানন্দ মনের উত্তাপ চাপিয়া কতকটা সহজ গলাতেই কহিল, তা হলে আমি এসে পড়ে ত ব্যাঘাত দিলাম।
ষোড়শী বলিল, দিয়ে থাকলেও আপনার দোষ নেই—আমিই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
জীবানন্দ কহিল, কিন্তু কেন? গল্প করতে নয় বোধ হয়?
ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল; বলিল, না গো মশায়, না—বরঞ্চ ঠিক তার উলটো। আজ আপনাকে আমি ভারী বক্বো। তাহার কণ্ঠস্বর ও কথা কহিবার ভঙ্গী দেখিয়া নির্মল ও জীবানন্দ উভয়েই আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া রহিল। ষোড়শী হঠাৎ একটুখানি গম্ভীর হইয়া বলিল, ছি, ছি, ওখানে অত কি করছিলেন বলুন ত? একটা সভার আড়ম্বর করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’জন অসহায় স্ত্রীলোকের কি কুৎসাই রটনা করছিলেন! এর মধ্যে একজন আবার বেঁচে নেই। এ কি কোন পুরুষের পক্ষেই সাজে? তা ছাড়া, কি প্রয়োজন ছিল বলুন ত?
সেদিন এই ঘরে বসেই ত আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন আমি পালন করব। আপনিও আপনার হুকুম স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, আমিও আমার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করিনি। এই নিন মন্দিরের চাবি, এবং এই নিন হিসাবের খাতা। বলিয়া সে অঞ্চল হইতে চাবির গোছা খুলিয়া এবং তাকের উপর হইতে একখানা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা পাড়িয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে রাখিয়া দিয়া কহিল, মায়ের যা-কিছু অলঙ্কার, যত-কিছু দলিল-পত্র সিন্দুকের ভিতরেই পাবেন, এবং আরও একখানা কাগজ পাবেন যাতে ভৈরবীর সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য ত্যাগ করে আমি সই করে দিয়েচি।
জীবানন্দ বোধ করি ঠিক বিশ্বাস করিতে পারিল না, কহিল, বল কি! কিন্তু ত্যাগ করলে কার কাছে?
ষোড়শী বলিল, তাতেই লেখা আছে দেখতে পাবেন।
তাই যদি হয় ত এই চাবিটাবিগুলো তাঁকেই দিলে না কেন?
তাঁকেই যে দিলাম। বলিয়া ষোড়শী মুখ টিপিয়া একটু হাসিল। কিন্তু সেই হাসি দেখিয়া এইবার জীবানন্দের মুখ মলিন হইয়া উঠিল। সে ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া সন্দিগ্ধ কণ্ঠে কহিল, কিন্তু এ ত আমি নিতে পারিনে। খাতায় লেখা নামগুলোর সঙ্গে যে সিন্দুকে রাখা জিনিসগুলোও এক হবে, সে আমি কি করে বিশ্বাস করব? তোমার আবশ্যক থাকে তুমি পাঁচজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ো।
ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আমার সে আবশ্যক নেই। কিন্তু চৌধুরীমশায়, আপনার এ অজুহাতও অচল। একদিন চোখ বুজে যার হাত থেকে বিষ নিয়ে খাবার ভরসা হয়েছিল, তার হাত থেকে আজ এটুকু চোখ বুজে নেবার সাহস হওয়া আপনার উচিত। অপরকে বিশ্বাস করবার শক্তি আপনার সত্য সত্যই এত কম, এ কথা আমি কোনমতে স্বীকার করতে পারিনে। নিন—ধরুন, বলিয়া সে খাতা এবং চাবির গোছা মাটি হইতে তুলিয়া একরকম জোর করিয়া জীবানন্দের হাতে গুঁজিয়া দিয়া বলিল, আজ আমি বাঁচলাম। আমার কোন ভারই ত কোনদিন নেননি, এইটুকুও না নিলে যে ধর্মে পতিত হবেন। তা ছাড়া, পরকালে জবাব দেবেন কি? বলিয়া সে হাসিতে হাসিতে কহিল, পরকালের চিন্তায় ত আপনার ঘুম হয় না, সে আমি জানি, কিন্তু যা হয়ে গেছে তা গেছে, ভবিষ্যতে কিছু কিছু চিন্তা করতে হবে তা বলে দিচ্চি। তাহার মুখের হাসি সত্ত্বেও কণ্ঠস্বর যেন ইহার শেষ দিকে কোমলতায় বিগলিত হইয়া উঠিল। কহিল, আর একটিমাত্র ভার আপনাকে দিয়ে যাবো, সে আমার গরীব দুঃখী প্রজাদের ভার। আমি শত ইচ্ছে করেও তাদের ভাল করতে পারিনি, কিন্তু আপনি অনায়াসে পারবেন। নির্মলের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমার কথাবার্তা শুনে আপনি আশ্চর্য হয়ে গেছেন, না নির্মলবাবু?