গৃহিণী বলিলেন, সব? কেন, মাতঙ্গিনীঠাকরুনকে কি আমি চোখে দেখিনি নাকি?
দেখে থাকলেও ভুলে গেছো।
গৃহিণী রাগ করিয়া জবাব দিলেন, ভুলিনি কিছুই। আজও তাঁর কাছে একশ’ টাকা পাই—না বলে উড়িয়ে দিলেন। ষোড়শী কখনো কাউকে ঠকিয়ে খায়নি, মিছে কথাও বলেনি।
কর্তা অত্যন্ত অপ্রসন্ন হইয়া কহিলেন, না—যুধিষ্ঠির! এই বলিয়া তিনি আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
গৃহিণী জামাতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আমি ত ভাবি এঁর কল্যাণেই নাতির মুখ আমরা দেখতে পেলাম। না বাবা, যে যাই বলুক, ঠক-জোচ্চোর সে মেয়ে নয়। তাইতে যখন শুনতে পেলাম ঠাকুরের পুজো করাটি সে ছেড়ে দিয়েচে, তখনি সন্দেহ হলো এ আবার কি? নইলে কারও কথায় আমি সহজে বিশ্বাস করিনি।
কর্তা চৌকাঠের বাহিরে পা বাড়াইয়াছিলেন, কান খাড়া করিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, বলি তার কল্যাণে ত নাতি পেলে, কিন্তু নাতির কল্যাণে মানসপুজোটি তিনি কেন অস্বীকার করলেন একবার ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারো না? বলিয়া তিনি প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই চলিয়া গেলেন।
নির্মলের খাওয়া শেষ হইয়াছিল, সেও উঠিয়া দাঁড়াইল; কহিল, ষোড়শীর ওপর থেকে দেখচি মায়ের ভক্তি আজও একেবারে যায়নি।
না বাবা, মিছে কথা কেন বলব, তার মুখখানি মনে হলেই আমার যেন কান্না পায়। এঁরা সকলে মিলে কেন যে তার বিপক্ষে এত লেগেচেন আমি ভেবেই পাইনে।
নির্মল একটুখানি মৃদু হাসিয়া কর্তার খোঁচার অনুসরণ করিয়া কহিল, কিন্তু মা, তার মন্ত্রতন্ত্রের বিদ্যের কথাটাও একটু ভেবো—
শাশুড়ী কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, দাসী আসিয়া ঘরের আড়ালে দাঁড়াইয়া কহিল, কে একজন জামাইবাবুকে ডাকতে এসেচে—বাবু খবর দিতে বললেন।
নির্মল হাতমুখ ধুইয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল ইতিমধ্যে গ্রামের অনেকেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, এবং সন্ধ্যার পরে মন্দিরে যে বৈঠক বসিবে তাহারই আলোচনা শুরু হইয়া গেছে। শিরোমণিমহাশয়ের আজ অমাবস্যার উপবাস, তিনি নির্মলকে ডাকিয়া আশীর্বাদ করিলেন, এবং বাবাজীকে হঠাৎ চিনিতে পারেন নাই, বলিয়া নিজের বৃদ্ধত্বের প্রতি দোষারোপ করিলেন। যে লোকটা থামের পাশে দাঁড়াইয়া ছিল সে নমস্কার করিয়া জানাইল যে, ভৈরবীঠাকরুন অপেক্ষা করিয়া আছেন, তাঁর সহিত বিশেষ কথা আছে।
নির্মলের হঠাৎ অত্যন্ত লজ্জা করিয়া উঠিল। সে পিছনে না চাহিয়াও স্পষ্ট অনুভব করিল সকলে উৎসুক- কৌতুকে তাহার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। ইহার অভ্যন্তরে যে গোপন বিদ্রূপ আছে, তাহা তাহাকে অপমানিত করিল; অন্য সময় হয়ত সে ইহাকে অত্যন্ত সহজে অবহেলা করিতে পারিত, কিন্তু আজ সে নিজের মধ্যে সে-জোর খুঁজিয়া পাইল না, কিছুতেই মুখ দিয়া বাহির করিতে পারিল না, চল, আমি যাচ্ছি। বরঞ্চ যেন লজ্জিত হইয়াই লোকটাকে বলিয়া ফেলিল, বল গে, আমার এখন যাবার সুবিধে হবে না।
শিরোমণি গায়ে পড়িয়া কহিলেন, ওকে জিরোবার একটু সময় দাও তোমরা—কি বল হে? বলিয়া তিনি চোখের একটা ইশারা করিয়া অকারণে হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে লাগিলেন। কেহ বা সে হাসিতে প্রকাশ্যে যোগ দিল, কেহ বা শুধু একটু মুচকিয়া হাসিল।
নির্মল সমস্ত অগ্রাহ্য করিয়া ভিতরে যাইতেছিল, শিরোমণি ডাকিয়া কহিলেন, বলি, বাবাজীকে কি ও বেটী কৌঁসুলি খাড়া করেচে নাকি?
নির্মল উদ্দীপ্ত ক্রোধ দমন করিয়া শান্তভাবে কহিল, মকদ্দমা বাধলে সে কাজ করতে হবে বোধ হয়।
শিরোমণি এ উত্তরের আশা করেন নাই, একটু থতমত খাইয়া বলিলেন, তা যেন করলে, কিন্তু বলে রাখি বাবাজী, এ পুঁটি মাছের প্রাণ নয়, বাঘা—ভাল্কোর সঙ্গে লড়াই—মকদ্দমা হাইকোর্টে না গড়িয়ে থামবে না, তা নিশ্চয় জেনো।
নির্মল কহিল, মামলা-মকদ্দমা কোথায় গিয়ে থামে এ ত আমার জানবার কথা শিরোমণিমশায়।
শিরোমণি কহিলেন, সে ত বটেই, এ হলো তোমার ব্যবসা, তুমি আর জানবে না! কিন্তু আরও ত ঢের খরচপত্র আছে, সে দেবে কে? বলিয়া তিনি মুখ টিপিয়া হাসিলেন। কিন্তু এ হাসিতে এবার কেহ যোগ দিল না।
নির্মল কহিল, অভাব হলে আমি দেব।
তাহার জবাব শুনিয়া শুধু শিরোমণি নয়, উপস্থিত সকলেই অবাক হইয়া গেলেন। রায়মহাশয় নিজেও ধৈর্য ধারণ করিতে পারিলেন না; রুক্ষকণ্ঠে বলিয়া ফেলিলেন, তোমাদের ঠাট্টা- তামাশার সম্পর্ক নয় নির্মল, বিশেষতঃ শিরোমণিমশাই প্রাচীন এবং সম্মানিত ব্যক্তি—উপহাস করা তোমার সাজে না।
নির্মল চুপ করিয়া রহিল; শিরোমণি সামলাইয়া লইয়া একটু হাসিবার প্রয়াস করিয়া কহিলেন, টাকা ত দেবে, কিন্তু দেবার গরজটা কি একটু শুনতে পাইনে?
নির্মল বলিল, আমার গরজ শুধু আপনাদের অন্যায় অত্যাচার। আমি যেখানে থাকি সেখানে যদি একবার খোঁজ নেন ত শুনতে পাবেন, জীবনে অনেক গরজই আমি মাথায় তুলে নিয়েচি।
যে লোকটা ডাকিতে আসিয়াছিল, সে তখনও যায় নাই; কহিল, আপনার কখন, যাবার সুবিধে হবে তাঁকে জানাবো?
আমার সময়মত দেখা করব বলো। বলিয়া সে বাটীর ভিতর প্রস্থান করিল।
সায়াহ্নবেলায় জনার্দন রায় প্রস্তুত হইয়া আসিয়া প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া ডাক দিয়া কহিলেন, মন্দিরে সকলে উপস্থিত হয়েচেন, তোমাকে তাঁরা ডাকতে পাঠিয়েচেন, যদি যাও ত আর বিলম্ব করো না।
নির্মল বাহিরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার যাওয়া কি আপনি প্রয়োজন মনে করেন?
জনার্দন কহিলেন, যাঁরা ডাকতে পাঠিয়েচেন, তাঁরা নিশ্চয়ই করেন, এই বলিয়া তিনি অগ্রসর হইলেন।