গৃহিণী পাথরের থালে মিষ্টান্ন ও বাটিতে দধি লইয়া প্রবেশ করিলেন, কহিলেন, কৈ বাবা, খাচ্চো না যে?
এই যে খাচ্চি, বলিয়া নির্মল আহারে মনোনিবেশ করিল।
কর্তা কহিলেন, নির্মলকে দিয়ে, আমার জন্যে একটু দুধ এনে দাও, শরীরটা ভালো নেই, দই আর খাবো না।
গৃহিনী প্রস্থান করিলে রায়মহাশয় বলিলেন, অন্ধকার দুর্যোগের রাত্রে সে তোমাকে হাতে ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল, তার জন্যে শুধু তুমি কেন বাবা, আমরা পর্যন্ত কৃতজ্ঞ; যে উপকার করে, তার অপকার করতে মন চায় না, কিন্তু এ ত আমাদের নিজেদের কথা নয় নির্মল, এ গ্রামের কথা, সমাজের কথা, দেব-দেবতার কথা, সুতরাং যা বড় কর্তব্য তা আমাকে করতেই হবে।
সে রাত্রের ঘটনা যে অপ্রকাশ নাই তাহা সে শুনিয়াছিল, অথচ নিজে গোপন করিয়াছিল বলিয়া লজ্জিতমুখে চুপ করিয়া রহিল।
কর্তা বলিতে লাগিলেন, দেব-দেবীরা ত কথা কন না, কিন্তু তাঁরা শোধ নেন। গ্রামের ভালো যে কখনো হয়নি, উত্তরোত্তর অবনতি হয়েই আসচে, মনে হয় এও তার একটা কারণ। প্রমাণের কথা বলছিলে, কিন্তু তুমি যে আসচো এই বা আমরা জানলাম কি করে? তুমি সন্তানতুল্য, তোমার কাছে সব কথা খুলে বলতে আমার বাধে, কিন্তু না বললেও নয়। জমিদারবাবু সে রাত্রে বোধ করি খেয়ে যাবার ফুরসত পাননি, ষোড়শী খাবার আনতে ঘরের বাইরে যেতে তাঁর চোখ পড়ল একটা চিঠির টুকরোর ’পরে। বোধ হয় তোমাকে লিখে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে শেষে হৈমকেই লিখেছিল। সেখানাও আজ দেখতে পাবে, তিনি সকালবেলা আসবার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
নির্মল ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, মিথ্যা কথা। সে নির্লজ্জ, নিজে অপরাধী, সেই মাতাল পাজী বদমাইশটার কথা আপনারা বিশ্বাস করেন? হতেই পারে না।
রায়মহাশয় শুধু একটু মৃদু হাসিলেন। অবিচলিতস্বরে কহিলেন, হতে পারে, এবং হয়েছে। জমিদার লোকটা যে নির্লজ্জ, মাতাল, পাজী, বদমাইশ তাও জানি। বোধ হয় আরও ঢের বেশী, নইলে তার কলঙ্কের কথাটা মুখে আনতেও পারত না। ওর নিষ্ঠুরতার অবধি নেই। গ্রামের মঙ্গলের জন্যও এ কাজে হাত দেয়নি, ঠাকুর-দেবতা ও মানে না। জোর করে মন্দিরে খাসি বলি দিয়ে খেয়েছিল। আবশ্যক হলে ও-পাষণ্ড মুরগী, শুয়োর, এমন কি গো-বধ করেও খেতে পারে।
তবুও তাঁকে আপনি সাহায্য করতে চান?
না, আমি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাই।
নির্মল অনেকক্ষণ স্থির থাকিয়া কহিল, আপনার কাঁটা উঠবে কি না জানিনে, কিন্তু সে নিষ্কণ্টক হবে। দেবীর যে সম্পত্তিটা সে বিক্রি করতে চায়, ষোড়শী ভৈরবী থাকতে তার সুবিধে হবে না।
রায়মহাশয় কহিলেন, সে গেলেও সুবিধে হবে না—আমি আছি।
তিনি আছেন এতবড় ঘটনাটা নির্মল বিস্মৃত হইয়াছিল, তাহার তৎক্ষণাৎ মনে হইল, জমিদারের সুবিধা না হইতে পারে, কিন্তু দেবীরও সুবিধা হইবে না। তবে সে সুবিধাটা যে কাহার হইবে তাহাও মুখ দিয়া বাহির করিল না।
রায়মহাশয় স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, বাবা নির্মল, তুমি বড় আইনব্যবসায়ী, অনেক বোঝ, কিন্তু সংসারে এসে খালি-হাতে আমাকে যখন লড়াই শুরু করতে হয়েছিল, তখন শুধু কেবল বিষয়-সম্পত্তি জমা করেই কাটাই নি, মাথার ভেতরেও কিছু কিছু সঞ্চয় করবার সুযোগ পেয়েছিলাম। তোমাকে লোকে বলেচে ওই জমিটুকুর ওপরেই জমিদারের লোভ—ষোড়শী কড়া মেয়ে, ও থাকতে কিছু হবার নয়, তাই নিজেদের কলঙ্কটা রটিয়ে তাকে তাড়াতে চায়। আচ্ছা বাবাজী, বীজগাঁর জমিদারের কাছে ওটুকু কতটুকু সম্পত্তি? তার টাকার দরকার, একটা না হলে আর একটা বিক্রি করবে—আটকাবে না। কিন্তু যেখানে তার সত্যিকার আটকেচে, সে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এই জঙ্গলের মাঝে মাসের পর মাস সে আর পারে না, শহরের মানুষ শহরে যেতে চায়। নির্মল, হৈমর মত তুমিও আমার ছেলে, তোমাকে বলতে সঙ্কোচ হয়, কিন্তু ওই ছুঁড়িটার ভালই যদি করতে চাও ত বলে দিয়ো তার ভয় নেই। চণ্ডীগড়ের ভৈরবীগিরির মুনাফা বেশী নয়, যা তার যাবে, জমিদার তার চতুর্গুণ পুষিয়ে দেবে, এ আমি শপথ করে বলতে পারি। সে তাকে কষ্ট দিতেও চায় না—কষ্ট দেবেও না, দু নৌকোয় পা দিয়ে থাকবার অসম্ভব লোভটা যদি সে একবার ত্যাগ করে।
নির্মল নিরুত্তরে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। শ্বশুরকে সে অনেকটা জানিত—এতটা জানিত না। এই শ্বশুর ষোড়শীর কল্যাণের পথ যাহা নির্দেশ করিয়া দিলেন, তাহাতে তর্ক করিবার প্রবৃত্তি পর্যন্ত আর তাহার রহিল না।
শাশুড়ীর দুধ গরম করিয়া আনিতে বিলম্ব হইল, তিনি ঘরে ঢুকিয়া স্বামীর পাতের কাছে বাটি নামাইয়া রাখিয়া আহারের স্বল্পতার জন্য জামাতাকে মৃদু ভৎর্সনা করিলেন, এবং এই ত্রুটি সংশোধন করিবার ভার স্বয়ং গ্রহণ করিয়া অদূরে উপবেশ করিলেন।
কর্তা দুধের বাটি মুখ হইতে নামাইয়া রাখিয়া কহিলেন, কিন্তু মেয়েটার একটা প্রশংসা না করে পারা যায় না—বেটী বিদ্যের যেন সরস্বতী। জানে না এমন শাস্ত্রই নেই।
গৃহিণী তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া কহিলেন, তা আর বলতে! দেখেচ ত কাজকর্মে সে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার শিরোমণিঠাকুর ভয়ে যেন কেঁচো হয়ে যান। চলে গেলে বুড়োর মুখ সহস্রধারে ফোটে, কিন্তু সুমুখে নিন্দে করবার ভরসা পান না।
কর্তা কহিলেন, না না, নিন্দে করবেন কেন, তিনি বরঞ্চ সুখ্যাতিই করেন।
গৃহিণী নাকের মস্ত নথে একটা নাড়া দিয়া ততখানিই প্রতিবাদ করিলেন। বলিলেন, হাঁ, বুড়ো সেই পাত্র কিনা! হিংসেয় ফেটে মরেন, আবার সুখ্যাতি করবেন! মনে নেই সেই অন্তুর বোনের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা নিয়ে কি কাণ্ডই না দিন-কতক করে বেড়ালেন! তা ছাড়া, ছুঁড়ি এদিকে যাই করে থাক, শোকে, দুঃখে, আপদে-বিপদে, গরীব-দুঃখীর এমন মা-বাপও গ্রামে কেউ নেই। যখনি যে কাজেই ডাকো, মুখে হাসিটি যেন লেগে আছে, না বলতে জানে না।
কর্তা খুশী হইলেন না, বলিলেন, হুঁ, সব ভৈরবীই ও-সব করে থাকে।