তাহার ঘনিষ্ঠ সম্ভাষণকে এবার সে সংশয়ের সহিত গ্রহণ করিতে চাহিল, তবুও তাহার মন ভিতরে ভিতরে উল্লসিত হইয়া উঠিল। কহিল, বলুন।
ষোড়শী কহিল, দুটি লোক দেবতাকে বঞ্চিত করতে চায়। একটি রায়মহাশয়, আর একটি জমিদার—
নির্মল বলিল, আর একটি আপনার বাবা। এঁরাই ত আপনাকেও বঞ্চিত করতে চান।
বাবা? হ্যাঁ, তিনিও বটে। এই বলিয়া ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল।
নির্মল বলিল, আমার শ্বশুরের কথা বুঝি, আপনার বাবার কথাও কতক বুঝতে পারি, কিন্তু পারিনে এই জমিদার প্রভুটিকে বুঝতে। তিনি কিসের জন্য আপনার এত শত্রুতা করেন?
ষোড়শী বলিল, দেবীর অনেকখানি জমি তিনি নিজের বলে বিক্রি করে ফেলতে চান, কিন্তু আমি থাকতে সে কোনমতেই হবার জো নাই।
নির্মল সহাস্যে কহিল, সে আমি সামলাতে পারব। বলিয়া সে কটাক্ষে ভৈরবীর মুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া দেখিল, ষোড়শী নীরব হইয়া আছে, কিন্তু তাহার মুখের কোন পরিবর্তন ঘটে নাই। খানিক পরে মুখ তুলিয়া ধীরে ধীরে কহিল, কিন্তু আরও অনেক জিনিস আছে, যা আপনিও হয়ত সামলাতে পারবেন না।
কি সে-সব? একটা ত আপনার মিথ্যে দুর্নাম?
ষোড়শী কোনরূপ উত্তেজনা প্রকাশ করিল না; শান্তস্বরে বলিল, সে আমি ভাবিনে। দুর্নাম সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, তাই নিয়েই ত ভৈরবীর জীবন নির্মলবাবু! আমি এই কথাটাই তাঁদের বলতে চাই।
নির্মল বিস্মিত হইয়া কহিল, এই কথা নিজের মুখে বলতে চান? সে যে স্বীকার করার সমান হবে।
ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল।
নির্মল সসঙ্কোচে কহিল, ওরা যে বলে—
কারা বলে?
অনেকেই বলে সে সময়ে আপনি—
কোন্ সময়ে?
নির্মল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অত্যন্ত সঙ্কোচ সবলে দমন করিয়া বলিল, সেই ম্যাজিস্ট্রেট আসার দিনে। তখন আপনার কোলের উপরেই নাকি—
ষোড়শী একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, তারা কি দেখেছিল নাকি? তা হবে, আমার ঠিক মনে নাই—যদি দেখে থাকে, তা সত্যি, জমিদারের মাথা আমিই কোলে করে বসেছিলাম।
নির্মল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে কহিল, তার পরে?
ষোড়শী শান্ত মুখখানি হাসির আভাসে একটু উজ্জ্বল করিয়া বলিল, তার পরে দিন কেটে যাচ্চে। কিন্তু কিছুতেই আর মন বসাতে পারিনে। সবই যেন মিথ্যে বলে ঠেকে।
কি মিথ্যে?
সব। ধর্ম, কর্ম, ব্রত, উপবাস, দেবসেবা, এতদিনের যা-কিছু সমস্তই—
তবু ভৈরবীর আসন চাই?
চাই বৈ কি। আর আপনি যদি বলেন, চাই না—
না, না, আমি কিছুই বলিনে। এই বলিয়া নির্মল তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, বেলা হয়ে যাচ্চে—এখন আমি চললাম।
ষোড়শীও সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল, আমারও মন্দিরের কাজ আছে। কিন্তু আবার কখন দেখা হবে?
নির্মল অনিশ্চিত অস্ফুটকণ্ঠে কি একটা কহিল, ভাল শোনা গেল না। ষোড়শী হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ভাল কথা, সন্ধ্যার পর আজই ত আমাকে নিয়ে মন্দিরে একটা হাঙ্গামা আছে, আসবেন?
নির্মল ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইয়া বাহির হইয়া গেল। ষোড়শী মুচকিয়া একটু হাসিল, তার পরে কুটীরের দ্বারে শিকল তুলিয়া দিয়া মন্দিরের অভিমুখে বহির্গত হইল।
দেনা-পাওনা – ২১
একুশ
শ্বশুর-জামাতা একত্রে আহারে বসিয়াছিলেন। শাশুড়ীঠাকুরানী দধি ও মিষ্টান্ন আনিতে স্থানান্তরে গেলে রায়মহাশয় কহিলেন, ষোড়শীর সঙ্গে তোমার দেখা হলো নির্মল?
নির্মল মুখ না তুলিয়াই কহিল, আজ্ঞে হাঁ।
কি বলে সে?
এরূপ একটা সাধারণ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। সে ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিসের সম্বন্ধে?
মন্দিরের সম্বন্ধে। বেটী ভৈরবীগিরি ছাড়বে, না চণ্ডীগড়ের নাম পর্যন্ত ডোবাবে? দেশের লোক ত আর বাইরের দশজনের কাছে মুখ দেখাতে পারে না এমনি হয়ে উঠেছে।
নির্মল চুপ করিয়া রহিল। চণ্ডীগড়ের ভৈরবীদিগের বিরুদ্ধে এ অপবাদ আবহমানকাল প্রচলিত আছে, এবং সেজন্যে গ্রামের কেহ কোনদিন লজ্জায় প্রাণত্যাগ করিয়াছে বলিয়া প্রবাদ নাই। স্বয়ং চণ্ডীমাতাও কখনো আপত্তি করিয়াছেন বলিয়া লোকে জানে না। ইহাদের রীতিনীতি, আচার-অনাচার সমস্তই সে শুনিয়া গিয়াছিল বলিয়া এ সম্বন্ধে মন তাহার নিরপেক্ষভাবেই ছিল। বিশেষতঃ ষোড়শীর অপবাদ সে বিশ্বাস করে নাই, সুতরাং ইহা মিথ্যা প্রমাণিত হইলেই সে খুশী হইত; কিন্তু এই প্রমাণকেই তাহার ভৈরবী-পদের একমাত্র দাবী বলিয়া সে একদিনও গ্রাহ্য করে নাই। তাহার শ্বশুরের ইঙ্গিত নূতনও নয়, ভীষণও নয়, অথচ এই কয়টা কথাতেই অকস্মাৎ আজ তাহার মন যখন চমকিয়া সজাগ হইয়া উঠিল, তখন নিজের মনের বিক্ষিপ্ততা অনুভব করিয়া সে যথার্থই আশ্চর্য হইয়া গেল। তাহাকে নিস্তব্ধ দেখিয়া রায়মহাশয় পুনশ্চ কহিলেন, কি বল হে?
নির্ভুল ও সময়োপযোগী উত্তর দিবার সময় ও অবস্থা নির্মলের ছিল না, সে শুধু পূর্ব কথারই পুনরুক্তি করিয়া কহিল, ভৈরবীদের দুর্নাম ত চিরদিনই আছে।
রায়মহাশয় অস্বীকার করিলেন না, বলিলেন, আছে। কিন্তু দুর্নাম জিনিসটা ত মন্দ, চিরকালের দোহাই দিয়েও মন্দটাকে চিরকাল চালানো চলে না। কি বল?
কিন্তু সে যে মন্দ এ কি নিশ্চিত প্রমাণিত হয়ে গেছে?
রায়মহাশয় অসংশয়ে কহিলেন, গেছে।
নির্মল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, কি করে গেল? নিশ্চয়-প্রমাণ কে দিলে?
রায়মহাশয় বলিলেন, যে দিয়েচে সে আজও দেবে। সন্ধ্যার পরে মন্দিরে যেয়ো, তার পরে বোধ হয় শ্বশুর-জামাই দু’জনকে দু’দিকে দাঁড়িয়ে আর সমস্ত গ্রামের হাসি-তামাশা কুড়োতে হবে না। এই ত তোমার ব্যবসা, অতএব নিশ্চয়-প্রমাণ যে কাকে বলে সে আমাকে আর তোমাকে বলে দিতে হবে না।