এই-সকল অভিযোগ ও আস্ফালনের প্রতিবাদ করিবার তথায় কেহ ছিল না, বরঞ্চ তাঁহারই পোষকতায় রমণীগণের মধ্য হইতে বর্ষীয়সী কে একজন বলিয়া ফেলিল, হতভাগীকে ঝাঁটা মেরে দূর কর শিরোমণিমশাই! বড় অহঙ্কার! বড় অহঙ্কার! জমিদারের বাগানবাড়িতে একরাত একদিন কাটিয়ে এসে বলে কিনা বাবুর অসুখ হয়েছিল! হয়েই যদি থাকে ত তোর কি! কিন্তু, বলিতে বলিতেই সহসা প্রতিমার প্রতি চক্ষু পড়িতেই তাঁহার ঈর্ষা-পীড়িত উচ্ছৃঙ্খল রসনা চক্ষের পলকে শান্ত ও সংযত হইয়া গেল; নিজের দুই কান তিনি তৎক্ষণাৎ দুই হাতে স্পর্শ করিয়া কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুমিষ্ট ও কোমল করিয়া অতঃপর কহিতে লাগিলেন, মায়ের ভৈরবী, নিন্দে করলে মহাপাপ হবে, নিন্দে আমি করচি নে, কিন্তু তাই বলে কি এতটা ভাল! সাহেব ভালমানুষ, তাই ছেড়ে দিলে, নইলে মিথ্যের দায়ে নিজের বাপের হাতেই যে দড়ি পড়ত!
কিন্তু ইহাতে উপস্থিত কেহই আর কথা যোগ করিল না। ষোড়শী যাহাই করুক সে যে চণ্ডীমাতার ভৈরবী এই সত্যটা হঠাৎ উত্থাপিত হইয়া না পড়িলে কুকথার প্রবাহটা বোধ করি এমন করিয়া তখনি থামিত না। কিন্তু তাই বলিয়া শিরোমণিমহাশয়ের রাগ পড়ে নাই, তিনি পুনশ্চ কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, হৈম মলিন অবসন্ন মুখখানি তুলিয়া আস্তে আস্তে কহিল, ও-সব কথা এখন থাক শিরোমণি জ্যাঠামশাই! তাড়াতাড়ি ত নেই—এখন আমার ছেলের পূজোটি হয়ে যাক।
তাই হোক, তাই হোক, বলিয়া শিরোমণি তাঁহার দুঃসহ বিরক্তি ও ক্রোধ তখনকার মত সংবরণ করিয়া চলিয়া গেলেন এবং হৈম অদূরে একধারে নির্জীবের মত নিঃশব্দে বসিয়া পড়িল। এই লজ্জাকর ও নিরতিশয় অপ্রিয়কর আলোচনা সে এইভাবে বন্ধ করিয়া দিল সত্য, পুরোহিতও সাড়ম্বরে দেবীর পূজা করিয়া দিলেন, কিন্তু হৈম তাহার অন্তরের মধ্যে উৎসাহ বা আনন্দের লেশমাত্র খুঁজিয়া পাইল না। তাহার পিতা ও লোকগুলার দুর্ব্যবহারে এবং বিশেষ করিয়া ওই ব্রাহ্মণের জঘন্য ইতরতায় তাহার যেমন বিতৃষ্ণা জন্মিল, ষোড়শীর অদ্ভুত আচরণেও তাহার মনের ভিতরটা তেমনি অজ্ঞাত গ্লানি ও সংশয়ের ব্যথায় পরিপূর্ণ হইয়া রহিল। তথাপি পুরোহিতের কাজটা কলের মত অবাধে চলিল। জাগ্রত দেবতার পূজা, বলিদান, হোম প্রভৃতি যাহা-কিছু অনেক সময় লইয়া সমস্তই ধীরে ধীরে সমাধা হইয়া আসিল, তাহার পুত্রের কল্যাণে শুভকর্মে কোথাও কোন বিঘ্নই ঘটিল না, কিন্তু ষোড়শী আর ফিরিল না।
দাসীর ক্রোড়ে ছেলেকে দিয়া হৈম যখন বাড়ি ফিরিয়া আসিল তখন বেলা প্রায় অপরাহ্ন,। আসিয়া দেখিল তাহার পিতা কিংবা শিরোমণিমহাশয় কেহই এতক্ষণ আলস্যে সময় কাটান নাই। বাহিরের বসিবার ঘরে তুমুল কোলাহল হইতেছে। তাহার প্রাবল্য দেখিয়া সহজেই বুঝা গেল একযোগে অনেকগুলি বক্তাই স্ব স্ব মন্তব্য প্রকাশের প্রয়াস করিতেছেন। অলক্ষ্যে কোনমতে পাশ কাটাইয়া তাহার বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পিতার দৃষ্টি এড়াইতে পারিল না; তিনি হাত নাড়িয়া আহ্বান করিয়া কহিলেন, হৈম, এদিকে একবার শুনে যা ত মা?
সে ক্লান্তদেহে মলিনমুখে ধীরে ধীরে গিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইয়াই দেখিল তথায় একটিমাত্র প্রাণী নীরবে বসিয়া আছেন, যাঁহাকে শ্রোতা বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে—সে তাহার স্বামী মিস্টার এন.বসু, ব্যারিস্টার। সকলের সমবেত বক্তৃতার উপলক্ষ একমাত্র তিনিই। বেলা দেড়টার ট্রেনে তাঁহার আসিবার একটা কথা ছিল বটে, কিন্তু ঠিক কিছু ছিল না। স্বামীকে দেখিয়া সে মাথার কাপড়টা আর একটু টানিয়া দিয়া দ্বারের অন্তরালে সরিয়া দাঁড়াইল। তাহার পিতা সস্নেহ অনুযোগের কণ্ঠে বলিলেন, তখন না বুঝে-সুঝে আমাদের কথায় হঠাৎ রাগ করে ফেললে মা, কিন্তু এখন নিজের কানেই ত সব শুনলে? ব্যাপার বুঝতে ত আর তোমার বাকী নেই, এখন তুমিই বল দেখি মা, অমন মেয়েমানুষকে কি ঠাকুর-দেবতার স্থানে রাখা যায়? এ ত ছেলেখেলা নয়!
হৈম অত্যন্ত মৃদুস্বরে জবাব দিল, আপনারা যা ভাল বোঝেন করুন।
তাহার পিতা হাস্য করিলেন, কহিলেন, করব বৈ কি মা, করব বৈ কি! করতেই ত গিয়েছিলাম। নির্মল এসেচে ভালই হয়েচে। যদি একটা মামলা-মকদ্দমাই বাধে ত বল পাওয়া যাবে। অপর পক্ষে বোধ করি তিনি জমিদারের সাহায্যের আশঙ্কাই করিলেন, কিন্তু শিরোমণি খামকাই উত্তপ্ত হইয়া উঠিলেন এবং হাঁকিয়া কহিলেন, ঘাড় ধরে বার করে দেব তার আবার নালিশ-ফরিয়াদ কি হে জনার্দন! জামাইবাবাজী যখন উপস্থিত আছেন, তখন তিনিই বিচার করুন। তিনিই আমাদের জজ, তিনিই আমাদের ম্যাজিস্টর! আমরা অন্য জজ-ম্যাজিস্টর মানিনে। কি বল হে যোগেন ভায়া? তুমি কি বল হে মিত্তিরজা? এই বলিয়া তিনি কয়েকজনের মুখের প্রতি সস্মিত দৃষ্টিপাত করিয়া সহসা কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন। এ ক্ষেত্রে যোগেন ভায়া ও মিত্তিরজার সম্মতিগ্রহণের তাৎপর্য ঠিক বুঝা গেল না, কিন্তু এটা বুঝা গেল, বড়লোক এবং দানশীল জামাইবাবাজী বিচার করুন, আর না করুন, ভবিষ্যতে তাঁহার অনুগ্রহলাভের পথটা শিরোমণি নিজের জন্য কথঞ্চিৎ প্রশস্ত এবং সুগম করিয়া রাখিলেন।
এই জামাইবাবাজী মানুষটির মাথার ডগা হইতে জুতার তল পর্যন্ত সমস্তই নিষ্কলঙ্ক সাহেবী। সুতরাং প্রত্যুত্তরে মৃদু-মধুর হাসিয়া তিনিও যে জবাবটুকু দিলেন তাহাও নিখুঁত সাহেবী। কহিলেন, এই-সব মোহন্ত-মোহন্তানী জাতের লোকগুলোর ব্যাপার সবাই জানে, এরা যেমন অসাধু তেমনি অসচ্চরিত্র। এদের অসাধ্য কাজ নেই। কোন কারণেই এদের প্রশ্রয় দেওয়া অনুচিত। কিন্তু আপনাদের ভৈরবীটি ঠিক কি করেচেন না-করেচেন সেটাও নিশ্চিত জানা উচিত।