গ্রামের এই দুই দিক্পালের সাংঘাতিক অভিযোগে উপস্থিত সকলেই যেন বিভ্রান্ত হইয়া উঠিল। ষোড়শীর পাণ্ডুর ওষ্ঠাধর কি একটা বলিবার চেষ্টায় বারংবার কাঁপিতে লাগিল, মুহূর্ত পরে হয়ত সে কি একটা বলিয়াও ফেলিত, কিন্তু হৈম দ্রুতপদে তাহার কাছে আসিয়া হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া শান্ত দৃঢ়স্বরে বলিল, না, আপনি কিছুতেই কোন কথা বলবেন না। পিতার মুখের প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, আপনারা ওঁর বিচার করতে চান নিজেরাই করুন, কিন্তু ওঁর মায়ের কথা ওঁর নিজের মুখ দিয়ে কবুল করিয়ে নেবেন, এতবড় অন্যায় আমি কোনমতে হতে দেব না। ওঁরা যা পারেন করুন, চলুন আপনি আমার সঙ্গে মন্দিরের মধ্যে। বলিয়া সে আর কোনদিকে লক্ষ্য না করিয়া ষোড়শীকে একপ্রকার জোর করিয়াই সম্মুখের দিকে ঠেলিয়া লইয়া চলিল।
দেনা-পাওনা – ০৮
আট
মন্দিরের অভ্যন্তরে একপাশে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া ষোড়শী কহিল, না বোন, আমি পূজো করব না।
কেন? বলিয়া হৈম সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, ভৈরবীর মুখ ম্লান, কোনরূপ আনন্দ বা উৎসাহের লেশমাত্র নাই এবং তাহার প্রশ্নের উওর সে যেন একটু চিন্তা করিয়াই দিল। কহিল, এর কারণ যদি কখনো বলবার দরকার হয়, সে শুধু তোমাকেই বলব, কিন্তু আজ নয়। তা ছাড়া আমি নিজেও বড়-একটা পূজা করিনে ভাই, যিনি এ কাজ নিত্য করেন তিনিই করুন, আমি কেবল এইখানেই দাঁড়িয়ে তোমার ছেলেকে আশীর্বাদ করি, সে যেন দীর্ঘজীবী হয়, নীরোগ হয়, মানুষ হয়।
সন্তানের প্রতি ভৈরবীর এই ঐকান্তিক আশীর্বচনেও মায়ের মন হইতে অপ্রসন্নতা ঘুচিল না। সে কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, কিন্তু আজকের দিনটা যে একটু অন্যরকমের দিদি! আপনি নিজের হাতে পূজো না করলে যে ওঁদের কাছে ভারী ছোট হয়ে যাবো! বলিয়া সে একবার উন্মুক্ত দ্বার দিয়া বাহিরের বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
ষোড়শীর নিজের দৃষ্টিও উহাকে অনুসরণ না করিয়া পারিল না। দেখিল সকলে এইদিকেই চাহিয়া আছে। তাহাদের চোখ ও মুখের উপর উৎকট কলহের চিহ্ন একান্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে—ঠিক যেন অধীর সৈনিকের দল কেবলমাত্র তাহাদের অধিপতির ইঙ্গিতের অপেক্ষায় বহু দুঃখে তাহাদের যুদ্ধ-বেগ সংযত করিয়া আছে। কিন্তু রায়মহাশয় সে ইঙ্গিত দিলেন না। তিনি ঘোর সংসারী লোক, মুহূর্তেই বুঝিলেন উপস্থিত ক্ষেত্রে তিনি প্রকাশ্যে ধনী কন্যা-জামাতার বিরুদ্ধাচরণ করিতে পারেন না। অল্পকালেই তাঁহার রক্তচক্ষু অবনত হইয়া আসিল, এবং কাহাকেও আর একটি কথাও না কহিয়া তিনি গাত্রোত্থান করিয়া ধীরে ধীরে মন্দির-প্রাঙ্গণ ত্যাগ করিয়া গেলেন। দুই-চারিজন অনুগত ব্যক্তি ভিন্ন কেহই তাঁহার সঙ্গ লইল না। বৃদ্ধ শিরোমণিমহাশয় রহিয়া গেলেন, এবং অনেকেই ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কি গড়ায় জানিবার জন্য অপেক্ষা করিয়া রহিল।
হৈম মিনতি করিয়া কহিল, মা-ভৈরবীর আশীর্বাদ আমরা মাতা-পুত্র মাথায় করে নিলাম, কিন্তু সে আশীর্বাদ আমি আপনাকে দিয়েই পাকা করে নিতে চাই দিদি।বেশ, আমি অপেক্ষা করতে পারব; পূজো আজ বন্ধ থাক—যেদিন আপনি আদেশ করবেন, এই উদ্যোগ-আয়োজন আবার নাহয় সেই দিনই হবে।
ষোড়শী মাথা নাড়িয়া কহিল, সে সুবিধে আর হবে কিনা এ কথা ত আজ তোমাকে নিশ্চয় করে বলতে পারবো না বোন!
হৈম সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, তবে কি মা-চণ্ডীর ভৈরবী আর আপনি থাকবেন না?
ষোড়শী শুধু বলিল, আজও ত তাই আছি।
হৈম কহিল, তবে? বলিয়াই দেখিতে পাইল দ্বারের চৌকাঠ ধরিয়া শিরোমণি দাঁড়াইয়া আছেন। চোখাচোখি হইতেই তিনি সদর্পে অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিলেন, তোমার বাবা আর আমি সেই কথাই ত এতক্ষণ বকে মরচি গো! ভালো, আমাদের সবুর সইবে। উনি কাল হোক, পরশু হোক, দু’দিন পরে হোক, দশদিন পরে হোক, পূজা করুন। দিন তার জবাব!
হৈম ষোড়শীর মুখের প্রতি নির্নিমেষে চাহিয়া রহিল, কিন্তু সে তার কোন উত্তর দিল না।
শিরোমণি ভৈরবীর ম্লানমুখের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া সহাস্যে কহিল, মা হৈম, এ ত সোজা প্রশ্ন নয়! এ পীঠস্থান, জাগ্রত দেবতা, দেবীর ভৈরবী ছাড়া এ দেব-অঙ্গ স্পর্শ করা ত যে-সে স্ত্রীলোকের কর্ম নয়! বুকের জোর থাকে, থাকুন উনি মায়ের ভৈরবী—আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা জানি সে আর ওঁর সাধ্যই নেই।
ইঙ্গিতটা এতই সুস্পষ্ট যে লজ্জায় হৈমর পর্যন্ত মাথা হেঁট হইয়া গেল। ষোড়শী নিজেও অভিভূতের মত ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অকস্মাৎ আপনাকে আপনি ধাক্কা মারিয়া যেন সম্পূর্ণ সচেতন করিয়া তুলিল। শিরোমণিকে সে কোন উত্তর করিল না, কিন্তু বুড়ো পূজারীকে হঠাৎ একটা ধমক দিবার মত তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিয়া উঠিল, ছোট ঠাকুরমশাই, তুমি ইতস্ততঃ করচ কিসের জন্যে? আমার আদেশ রইল, দেবীর পূজা যথারীতি সেরে তুমি নিজের প্রাপ্য নিয়ো, বাকী মন্দিরের ভাঁড়ারে বন্ধ করে চাবি আমাকে পাঠিয়ে দিয়ো। হৈমর প্রতি চাহিয়া কহিল, অনেক আয়োজন করেচ, এ-সব নষ্ট করা উচিত হবে না ভাই। আমি আশীর্বাদ করে যাচ্চি এতেই তোমার ছেলের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হবে। আমার নিজের পূজা-আহ্নিক এখনো বাকী রয়েচে, আমি এখন চললাম—সময় যদি পাই ত আবার আসব। এই বলিয়া সে আর বাদানুবাদ না করিয়া বাহির হইয়া গেল।
মুহূর্তকয়েকের জন্য সকলেই নির্বাক্ হইয়া রহিল, কিন্তু ক্ষণপরেই অপমান ও অবহেলায় বৃদ্ধ শিরোমণি অঙ্কুশ-আহত পশুর ন্যায় ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার বয়সোচিত মর্যাদাবোধ ও ছদ্মগাম্ভীর্য কোথায় ভাসিয়া গেল, দৃষ্টিবহির্ভূত ষোড়শীর উদ্দেশে একটা অভদ্র ইঙ্গিত করিয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন, এবার মন্দিরে ঢুকলে গলাধাক্কা খেয়ে মরতে হবে জানিস! নষ্ট মেয়েমানুষ কোথাকার! ভেবেচিস গাঁয়ে মানুষ নেই? আজও জনার্দন রায় বেঁচে, আজও সর্বেশ্বর শিরোমণি মরেনি, তা জানিস!